আমাদের সমাজের চালচিত্র ও ধর্ষণ

আমাদের সমাজের চালচিত্র ও ধর্ষণ 

ধর্ষণ...!!
শব্দটা যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে একেবারে মিশে গেছে।
পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ব্লগ সাইট, ফেসবুক সহ সকল পাবলিক প্লেসে, এমনকি বন্ধুদের আড্ডাতেও এই শব্দটি বহুল ব্যবহৃত।
শব্দটা আমরা যত সহজে উচ্চারণ করি, ভিকটিমেরা তার চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণার সাথে শব্দটা সহ্য করে থাকে। যে যন্ত্রণা হয়তো অনুধাবন করার ক্ষমতাটুকু আমাদের কারো নেই।
যন্ত্রণার তীব্রতা যে কতখানি, তা আমরা সাম্প্রতিক একটা ঘটনার দিকে চোখ রাখলেই বুঝতে পারি। ছোট্ট মেয়েটার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে বাবা আর মেয়ে মিলে একসাথে আত্মহনন করেছিল রেললাইনে মাথা পেতে। তাদের কাছে এই শব্দের যন্ত্রণা মৃত্যুর থেকেও অনেক ভারী।
যে উদাহরণটা দিলাম, এটা খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ। প্রতিদিনই বহু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আর মিডিয়ায় আসে তার তলানি স্বরূপ ক্ষুদ্র একটা অংশ। আর সেটা নিয়ে আমরা অনলাইনে কয়েকদিন লাফালাফি করি। অবশেষে কোন সমাধান ছাড়াই নতুন নতুন ঘটনার নিচে চাপা পড়ে যায় সেই লাফালাফি। এদিকে ধর্ষিতার পরিবারের যন্ত্রণা, যন্ত্রণার যায়গাতেই রয়ে যায়। সমাধান না পেয়ে সেই যন্ত্রণা চেপে তারা সমাজে বেঁচে থাকে নিচু হয়ে। নিচুর কথা বললাম কেন, তার পুরোটা বলতে গেলে আমার লেখা কখনোই থামবে না। তবুও সংক্ষেপে বলি।
আমরা তথা আমাদের সমাজই ধর্ষিতাকে নিচু করে রাখে। ধর্ষণের বিচার না করে বরং ধর্ষিতাকে ও ধর্ষিতার পরিবারকে ছোট করে দেখে। দোষ না করেও, নির্যাতিত হয়েও তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, কথা বলতে পারে না। অথচ, ধর্ষক ঠিকই বীর-দর্পে চলাফেরা করে। মাথা উঁচু করে চলে। একই চায়ের টেবিলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে চায়ের কাপে চুমু খায়। আমাদের সমাজটাই এমন। নারী জাতির সম্মানটা কেবল নিজের "মা" আর "বোন" নামক শব্দের মাঝে সীমাবদ্ধ। বাকি সব নারী "মাল" আর ভোগের পণ্য। রাস্তাঘাট, যানবাহন থেকে শুরু করে যেখানেই কোন নারী দেখা যায়, তারা সবাই "মাল"। লোলুপ দৃষ্টি তাদের পিছু ছাড়েনা কখনোই। এমনকি ফেসবুকে কোন মেয়ে ছবি আপলোড দিলেও তার মাঝে মানুষ যৌনতা খোঁজে। হোক সে ক্লাসমেট, কাজিন অথবা এলাকার কোন মেয়ে। আপনার আশেপাশের পাবলিক প্লেস গুলোয় চোখ-কান খোলা রাখলেই একথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। দূরে যেতে হবেনা। আমাদের তথা আমাদের সমাজের মনোভাবটাই এমন। যৌনাকাঙ্ক্ষা এতোই বেশি যে, আমরা তা রগে রগে ধারণ করে পথ চলি আর নিজের ব্যক্তিসত্তা ভুলে গিয়ে নির্লজ্জের মতো তা নারীদের দিকে ছুঁড়ে মারি।
যাক এসব কথা। ধর্ষণের কথায় আসি...
সম্প্রতি আলোচিত এক ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সাদাতের বাবা বলেছে, "আমার ছেলে অন্যায় করেছে তো কি হয়েছে, আমিও করি"। বেহায়া, নির্লজ্জ কোথাকার। কোন বাবা তার ধর্ষক ছেলেকে নিয়ে স্ব-গর্বে এমন কথা বলতে পারে, সে ধারণা আমার ছিল না। তার উচিত ছিল, জাতির কাছে তার ছেলের কুকীর্তির জন্য ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা না চেয়ে বরং তার ছেলের বাজে কর্ম ঢাকতে নিজেকেও সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একটা মানুষ আদব-কায়দা শেখে তার পরিবার থেকে। যে পরিবারে এমন বাবা আছে সে পরিবারের ছেলে আদব-কায়দা হীন ধর্ষক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কুলাঙ্গার ছেলেকে বাঁচাতে কোন কাণ্ডজ্ঞানহীন বাবা যদি এমন কথা বলতে পারে, সম্ভ্রম হারা কোন মেয়ের বাবাও ওইসব ধর্ষকের কাণ্ডজ্ঞানহীন বাবাকে রাজপথে ফেলে জুতাপেটা করতে করতে মেরে ফেলার অধিকার রাখে। যদিও অধিকার নামক শব্দটা এদেশের প্রশাসকদের দলিলে নেই বলেই চলে।
ধর্ষণের সঠিক বিচার না থাকার কারণে আমাদের সমাজের চিত্রটা এমন। সঠিক বিচার সমাজের অপরাধ কমিয়ে আনতে সক্ষম। আফসোস, আমাদের এই জিনিসটার বড় অভাব। যদি এসব অপরাধের সঠিক বিচার হতো, ধর্ষক সমাজ তাদের কার্য সম্পাদনে একটু হলেও ভয় পেতো আর অপরাধ কমতো। এই বিচার নিয়ে কথা বললে আবার বিশাল রচনা হবার সম্ভাবনা আছে। তবুও ছোট করে বলি...
বিচারকের আসনে তথা প্রশাসনে যারা আছে তাদের জগতটা সম্পূর্ণ আলাদা। এদের পিছনের দিনগুলোতে তাকালে দেখা যাবে, কারো কারো জীবনে এরকম কার্যের অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকটা রয়েছে। লোকসমাজে প্রচলিত আছে, "কচু গাছ কাটতে কাটতে নাকি ডাকাত হয়"। কথাটার সত্যতা প্রমাণে প্রশাসনের লোকগুলো বেশ পটু। ছোটবেলা থেকে যারা অনিয়ম দুর্নীতি করে আসছে, তারাই একসময় ক্ষমতায় বসছে। এদের থেকে সুবিচার পাওয়াটা অমাবস্যার চাঁদের মতো। অন্ধকারে থেকে থেকে অন্ধকারের কাজগুলোই তাদের বেশি আপন। যদিও মাঝে মাঝে দু একটা বিচার দেখা যায়, সেগুলো হয় তাদের গদি পাকা-পোক্ত করার জন্য অথবা লোক দেখানো।
তনুর জন্য আমাদের আন্দোলন কতখানি জোরালো ছিল... টিকেছে? টিকেনি...!! বিচার এখনো প্রক্রিয়াধীন। কবে শেষ হবে, আদৌ হবে কিনা, তা কেবল তারাই জানে। জোর যার, মুল্লুক তার। অথচ, এই তনুরা যদি প্রশাসকের পরিবারের কেউ হতো, ধর্ষককে গ্রেফতার থেকে শুরু করে বিচার কার্য শেষ হতে সময় লাগতো হাতে গোনা কয়েকটা দিন। আমরা কেউ প্রশাসক পরিবারের না, সবাই তনুর পরিবারের, তাই সুবিচার হয়তো আমাদের প্রাপ্য না।
প্রতিদিন কত মেয়ে যে ধর্ষিতা হয় তার শেষ নেই। কেউ সামনে এসে বিচার চায়, কেউ গোপনে যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে লোকসমাজে টিকে থাকার তাগিদে। গতকালও একটা খবর পেলাম, প্রায় বছর-খানেক সময় ধরে মা-খালা সহ এক মেয়েকে ধর্ষণ করে আসছে। কতটা জঘন্য একটা খবর। একবার ভাবুন। লোক-লজ্জার ভয়ে অথবা ভিডিও ফ্ল্যাশ হয়ে যাবার ভয়ে টানা এক বছর ধরে নীরবে ধর্ষণের যন্ত্রণা সয়ে আসছে। ভিডিও শব্দটা উচ্চারণ করতেই অনেকগুলো খবর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। যাক, বাদ দিলাম এসব ভিডিওর কথা। যারা এইসব কাজগুলো করে, তাদের যদি বিচার হতো, পুরোপুরি না হোক, অপরাধ কিছুটা হলেও কমতো। মাথাব্যথা নেই আমাদের প্রশাসনের। সমস্যা কি !! তার মেয়ে তো নিরাপদেই আছে। একবার আপনার মেয়েকে ঠেলে দিন না কোন এক ধর্ষকের হাতে। খুব সহজেই বুঝবেন এসবের যন্ত্রণা কতখানি। ধর্ষিতাকে কোন এক মেয়েকে নিজের মেয়ের জায়গায় বসান না একবার। দেখেন, যন্ত্রণা কতখানি। আপনাদের কাছে আমাদের প্রাপ্যতা তো এটুকুই। আর এই প্রাপ্যটা যদি না'ই মিটাতে পারেন, তবে ছেড়ে দিন আপনার গদি। আপনার মত কাণ্ডজ্ঞানহীনের আসন বিচারকের আসনে শোভা পায় না। তেলে মাথায় তেল দিয়ে তথা ক্ষমতাবানদের পা চাটাই যদি হয় আপনার কাজ, তবে ওইসব ক্ষমতাবান ধর্ষকদের "দণ্ডটা" মুখে নিয়ে চোখ বুজে চুষতে থাকেন; আরাম পাবেন। অর্থলোভ আর ক্ষমতা আপনাদের মানসিকতাকে কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কুকুরের সাথে তুলনা করেও ভুল করলাম। কুকুর অন্তত মনিবের নুন খেয়ে মনিবের কাজ করে। ধর্ষিতার পরিবারের সমর্থনেই হয়তো আপনি আপনার গদিতে বসতে পেরেছেন। কিন্তু তার জীবনের কঠিন-তম অবস্থায় আপনার লেজ গুটিয়ে ক্ষমতাবান ধর্ষকের দণ্ডে তেল মেজে দিচ্ছেন। শত ধিক আপনাদের। শত শত ধিক...!!!
নবীনতর পূর্বতন