গোধূলির গল্প


গোধূলির গল্প:

আমরা দুজন পাশাপাশি বসে। আমি আর আমার বন্ধু শিশির। শিশির অবশ্য ওর আসল নাম না। এটা ওর ভালোবাসার দেয়া নাম। কে জানে হয়তো রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী পড়ে এ নাম দিয়েছিলো। নইলে কি করে জানলো যে ভোরের শিশির সকালের আলোয় মিলিয়ে যায়?

আমরা দুজন পাশাপাশি বসে। আমি আর আমার বন্ধু শিশির। পড়ন্ত বিকেল। গোধূলির ম্রিয়মানতা ক্রমেই আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আমাদের বুকের ভেতর থেকে লাভার মতো উদ্গরিত হচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া। শূন্যে দৃষ্টি রেখে শিশির বলে চলছে অবিরাম। আমি শুনছি, শিশিরের মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আমার হৃদপিণ্ডকে বিদ্ধ করছে তীরের মতো। শূন্যে দৃষ্টি রেখে শিশির বলে চলছে অবিরাম।
অবনী ওর বন্ধু ছিল, একসাথে স্কুলে পড়ত। দশ বছর আগে কোন এক মহালগ্নে শিশির অবনীকে বলেছিল ‘ভালোবাসি’। জোয়ার-ভাটার মতো দোল খেয়ে ওঠে অবনীর হৃদয়। সাড়া মেলে। তারপর পরস্পরের হাত ধরে শুরু হয় পথচলা। প্রতিদিন স্কুলে দেখা হতো, কথা হতো তবু মনের গহীনের কথাগুলো ওরা ভাগাভাগি করতো চিঠিতে। অবনীকে নিয়ে শিশির কবিতা লিখতো, ভালোবাসার কবিতা। কবিতা পড়ে অবনী শিশিরকে আরও গভীর ভাবে ভালোবাসতো। এমনি করে পেরিয়ে যেত দিন।
হঠাৎ একদিন শিশিরের লেখা একটা চিঠি গিয়ে পড়লো অবনীর মায়ের হাতে। দুই পরিবারে জানাজানি হয়ে গেলো। প্রথম বাধা আসলো। তবু এই বাধাকে অতিক্রম করে চলছিলো ওদের ভালোবাসাবাসি। এস,এস,সি পাশ করে দুজনে ভর্তি হল দুই কলেজে। দূরত্ব বেড়ে গেলো, মন তবু রইলো কাছাকাছি। হঠাৎ হঠাৎ দুজনের দেখা হতো। এরই মধ্যে কেটে গেলো দুইটি বছর।
এইচ,এস,সি পাশ করে দুজনে ভর্তি হল ঢাকায়। ওদের জীবনে এটা আরেক নতুন অধ্যায়। দুজন দুজনকে কাছাকাছি পেয়ে যেন স্বর্গ পেলো। প্রতিদিন দেখা হতো। কখনো হাজার মানুষের ভিড়ে হাত ধরে দুজনের হাঁটাহাঁটি, আবার কখনো নিভৃতচারিতা। বেশ চলছিলো ওদের জীবন। কত স্বপ্ন, কত স্বপ্ন! কিভাবে কাটবে সারাটা জীবন দুজনে পাশাপাশি বসে চলতো তারই পরিকল্পনা।
অবনীর পরিবার ওকে বিয়ে দিতে চায়। ভালই তোরজোড় শুরু হল। কিন্তু অবনীর জোরে সব ভেস্তে যেত। ওরা ভাবে বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু শুধু ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবন চলে না। দুজনই বেকার। চেষ্টা চলে সময় পার করার। আর তো একটা বছর, অনার্স শেষ হলেই একটা কিছু হয়ে যাবে। তারপরে একসাথে থাকা। কত স্বপ্ন, কত স্বপ্ন বাসা বাঁধে দুজনের চোখে!
এরই মাঝে একটা শুভ লক্ষণ। অবনীর সরকারি চাকরি হল। এখন আর বিয়ে করতে সমস্যা নেই। কিন্তু পরিবারের অমতে ওরা বিয়ে করতে চাইলো না। আবার অপেক্ষা। অবনী চাকরির প্রয়োজনে ঢাকা থেকে চলে গেলো। আবার দূরত্ব। কিন্তু সম্পর্ক থেমে থাকলো না। নিয়মিত কথা হতো মুঠোফোনে। এমনি করে পেরিয়ে যেত দিন।
দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। মাঝে মাঝে শত মাইল পাড়ি দিয়ে কেউ একজন ছুটে আসতো, দেখা হতো, ভালোবাসাবাসি হতো, চলতো হাজার স্বপ্নের বুনন।
পৃথিবীতে কোনোকিছুই অবিনশ্বর নয়। মানুষের মন তো নয়ই। অবনীর হঠাৎ পরিবর্তন হতে লাগলো। শিশিরের সাথে ঠিক মতো কথা বলতো না, খোঁজ নিতো না। অবনীর কি হল? না, শিশির অনেক বিশ্বাস করতো অবনীকে তাই কোন সন্দেহ করতে পারলো না। শিশির জানে, অবনী বলেছিল, যা-ই করি না কেন আমি তোমার, তোমারই থাকবো’। শিশির নিশ্চিন্ত ছিলো, অবনী ওকে কখনো ছেড়ে যাবে না।
কয়েক দিন ধরে অবনীর সাথে যোগাযোগ হয় না। শিশির ভাবে কি হলো, অবনী কোনো বিপদে পড়লো না তো? চেষ্টা করেও কোনো যোগাযোগ করা গেলো না। শিশির অপেক্ষায় থাকলো।
কয়েক দিন পর, শিশির খবর পেলো যে একজন ওকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। কেন? শিশিরের জন্য অপেক্ষায় ছিল বলেই অবনীকে সে পেয়েছে!
শূন্যে দৃষ্টি রেখে শিশির বলে চলছে অবিরাম। কখন যে অন্ধকার আমাদের গ্রাস করেছে বুঝতেই পারিনি। দূরে জ্বলে ওঠা আলোগুলি আমার চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে।
নবীনতর পূর্বতন