তেলাপোকা


শফিক প্রচন্ড তেলাপোকা ভয় পায়। বাঁকানো শুঁড় আর কাটা কাটা পা ওয়ালা পোকাগুলোকে দেখলেই তার ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আর কি অদ্ভুত ব্যপার তার বাড়িতে এই একটি পতঙ্গের কোন অভাব নেই। খাটের নিচে, বুক শেলফের চিপায়, বাথরুমের কোনে, কোথায় নেই এই তেলাপোকা। রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে কেউ যদি অন্ধকারে পানি খেতে যায় বা বাথরুমে যায় তবে পায়ের নিচে গোটা দুই তেলাপোকা তো পড়বেই।

শফিকরা আগে মাদারটেক থাকত। শুধুমাত্র বাড়িতে তেলাপোকার উৎপাত বেরে যাওয়ায় সে বাসা বদলে খিলগাঁয় পাঁচ তলা উঁচুতে ফ্ল্যাট ভারা নিল। ভাবল এতো উঁচুতে পোকামাকড় পৌঁছতে পারবে না। তার সে আশায় গুরে বালি, তেলাপোকার উৎপাত এখানেও। শফিকের মনে হল, পুরনো আসবাবপত্রে তেলাপোকা বাসা বেঁধেছে, তাই সে বাসা বদলে যেখানেই যাচ্ছেন তেলাপোকাও তার সঙে সঙে যাচ্ছে। সে পুরনো বেশ কিছু ফার্নিচার বেচে দিল। তার স্ত্রি শাহানা বেশ নাখোশ হল, বিশেষ করে বাপের বাড়ি থেকে দেয়া আলমারিটা বেচে দেয়ায় সে শফিকের সাথে দুই দিন কোন কথা বলল না। কিন্তু এতো কিছু করেও সমস্যার কোন সমাধান হল না, তেলাপোকা শফিকের পিছু ছাড়ল না।

কিছু মানুষের প্রতি কিট পতঙ্গের অপেক্ষাকৃত বেশি আকর্ষিত হয়, শফিকও সম্ভবত সেই ধরনের কেউ। রাতের বেলা তার গায়ে তেলাপোকা উঠবেই। প্রায়ই তার কাপড়ের মধ্যে তেলাপোকা লুকিয়ে বসে থাকে। শফিক না বুঝে ওই কাপড় গায়ে দিয়ে পকার স্পর্শ পাওয়া মাত্র চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। শফিকের চার বছরের মেয়ে নিশি বাবার লাফঝাঁপ দেখে সে কি হাসি। মাঝে মাঝে শাহানাও মেয়ের সাথে হাসিতে যোগ দেয়, কখনো আবার স্বামির এহেন ছেলেমানুষি আচরনে ভ্রু কুচকে তাকায়।

তেলাপোকা দেখলে একটু গা ঘিনঘিন করে না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু শফিকের তেলাপোকা ভিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য এর কারন আছে। শফিকের বয়স যখন নয়-দশ হবে, তখন একবার তাকে পাড়ার বদ পোলাপান জাপটে ধরেএকটা ঢাউস তেলাপোকা জ্যান্ত গিলিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই থেকেই শফিকের তেলাপোকা ভিতি মাত্রাতিরিক্ত।

শফিক শেইভ করছে। ধারালো রেজরের আচরে ঘন শুভ্র ফেনার প্রলেপ কেটে কেটে মসৃণ ত্বক অনাবৃত হচ্ছে। বাথরুমের ভেতর বেশ গরম। শফিকের ঘাম ঝরছে। এমনি সময় কোত্থেকে এক তেলাপোকা উড়ে এসে শফিকের ঘাড়ে পড়ল। শফিক চমকে উঠে একটা ছোটখাটো লাফ দিল। গালের সাথে চেপে ধরে ব্লেড এই সুযোগে একটা গভির দাগ ফেলে দিল শফিকের মুখে। শফিক দাঁত চেপে খিস্তি করে উঠল। গালটা বেশ ভালই কেটেছে, শুভ্র ফোমের উপর একটা টকটকে লাল ধারা একেবেকে চিবুক বেয়ে নেমে আসছে। শফিক তাড়াতাড়ি টিস্যু পেপারে ডেটল ভিজিয়ে ক্ষতস্থানে চেপে ধরল। তীক্ষ্ণ যন্ত্রনায় তার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। টিস্যু সরিয়ে সে আয়নায় ভালো করে দেখার চেষ্টা করল কতটুকু কেটেছে।

এই সময় শফিকের জীবনের সবচে অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটে গেল। বেসিনের নিচ থেকে একটা গাবদা তেলাপোকা ফুড়ুৎ করে লাফ দিয়ে এসে পড়ল ওর মুখে। তারপর শফিক কিছু বুঝার আগেই তেলাপোকাটা সড়সড় করে ওর গালের কাটা দিয়ে চামড়ার ভেতরে ঢুকে গেল।

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে শফিক এমনকি একটা চিৎকার দেয়ার ও সময় পেল না। সম্বিত ফিরে পেতেই শফিক পাগলের মত নিজের গাল খামচাতে শুরু করল। মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই জান্তব চিৎকার বেরিয়ে আসছে। দেখতে দেখতেই সে খামচে চিবুকের ক্ষতটা আরও বড় করে ফেলল। চেচামেচি শুনে শাহানা যখন বাথরুমে উঁকি দিল ততক্ষনে শফিকের ডান গাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। শফিক নখ বিধিয়ে সাথে প্রায় ইঞ্চি খানেক চামড়া তুলে এনেছে। শাহানা ছুটে গিয়ে শফিকের হাত চেপে ধরল। কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে এমন করছ কেন? শফিক কোন উত্তর দিল না। সে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে।

***

শফিককে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। উন্মাদের মত সে নিজের গাল খামচানোর চেষ্টা করছে। তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নেয়া হল। ডাক্তার তার ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যন্ডেজ করে দিলেন। কিন্তু এতে তার মাথা ঠাণ্ডা হল না। কাপাকাপা গলায় সে ডাক্তার কে জানালো তার চামড়ার ভেতর একটা তেলাপোকা ঢুকে গেছে। যেভাবে হোক ডাক্তারকে ওটা বের করে দিতেই হবে। রুগির আবদার শুনে ডাক্তার তো হেসেই খুন। তার হাসি দেখে শফিক খেপে গেল। ডাক্তারকে গাল দিয়ে বসল। ডাক্তারও চট করে উত্তেজিত হয়ে গেলেন, কম্পাউন্ডারকে ডেকে শফিক আর শাহানাকে বের করে দিলেন।

রাস্তায় নেমে শফিক বাড়ি ফিরতে রাজি হল না। আরেকজন ডাক্তার দেখাতে হবে। সেখানে কাজ না হলে হাসপাতালে যেতে হবে। যেভাবেই হোক তার শরীর থেকে তেলাপোকাটা বের করতে হবে।

***

গভির রাত। কিন্তু শফিকের চোখে ঘুম নেই। সে বাতি জেলে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। তার শরিরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। তার শরিরের ভেতর একটা তেলাপোকা ঢুকে গেছে, কি সাঙ্ঘাতিক ব্যপার। কিন্তু কথাটা কাউকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। এমনকি শাহানা পর্যন্ত তার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে না, এমন ভাব করছে যেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অথচ সে চামড়ার নিচে তেলাপোকাটার উপস্থিতি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। পোকাটা ওটার লোমবহুল পা গুলো ওর চামড়ার ভেতরে ঘসছে, শফিকের শরিরে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পোকাটা তার শরিরের ভেতর চলাচল করতে চেষ্টা করছে। প্রথমে গালের মধ্যেই ঘাপটি মেরে ছিল। এখন মনে হচ্ছে ওটা চোয়াল বেয়ে গলার কাছে চলে যাচ্ছে।

খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে আছে শাহানা। তার প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে কিন্তু চোখে ঘুম আসছে না। হঠাত শফিকের কি হয়ে গেল। মানুষটা সবসময়ই পোকামাকড় ভয় পেত, ব্যপারটা কিছুটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হলেও শাহানা কখনই তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে শফিককে আর কখনো এমন পাগলের মত আচরন করতে দেখেনি শাহানা। কি করবে কোন দিশা না পেয়ে মা’কে ফোন দিয়েছিল। মা বলেছে রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে দিতে। কাল সকালে উনি এসে দেখে যাবেন।

বাবার অবস্থা সবচে সহজ ভাবে নিয়েছে ছোট্ট নিশি। প্রথম থেকেই সে চোখ বড়বড় করে বাবাকে দেখছে আর একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। এখন সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে খাটের কোনে।

শফিক ঢোক গিলে বলল, “শাহানা, পানি খাব।”

শাহানা পানি আনতে গেল। শফিক বসে বসে ঘামতে লাগল। পোকাটা আবার নড়তে শুরু করেছে। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে পোকাটা তার চামড়ার দেয়ালে আঁশ অয়ালা পা বিঁধিয়ে একটু একটু করে উপরে উঠতে শুরু করেছে। শফিকের প্রবল ইচ্ছে করছে নখ দিয়ে খামচে গাল কেটে তেলাপোকাটা বের করে আনে। তেলাপোকাটা ওর চোখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সেকি!! পোকাটা কি ওর চোখ খেয়ে ফেলবে!!!

***

পরের দিন শফিক অফিসে গেল না। তার ধারনা তার শরিরের সর্বত্র তেলাপোকাটা ঘুরে বেরাচ্ছে। এক রাতেই ওর চেহারা অনেক বদলে গেছে, চুল উস্কু খুস্কু, চোখ কোটরাগত। শুধু তাই না, ওর আচার আচরন ও খ্যপার মত হয়ে গেছে। হঠাত হঠাত শরিরের এখানে সেখানে থাবা মারছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। নিশি গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, তেলাপোকাটা এখন কি করছে?” উত্তরে শফিক এত জোরে গর্জে উঠল যে নিশি ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। বিকালের দিকে শাহানার মা আসলেন। মেয়ে জামাইয়ের অবস্থা দেখে গম্ভীর হয়ে এক টুকরো কাগজে শাহানাকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা লিখে দিলেন। ওকে বললেন দেরি না করতে। শাহানা পরের দিনই শফিককে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল।

সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি। তিনি আর সবার মত শফিককে নিয়ে হাসাহাসি করলেন না। মনযোগ দিয়ে শফিকের কথা শুনে গেলেন। সব শেষে বললেন, “তেলাপোকাটা এখন কোথায় আছে?” শফিক হাত দিয়ে দেখাল কাঁধের কাছে। ডক্টর বললেন, আপনি এক কাজ করতে পারেন। আপনি জায়গাটা স্ক্যান করে দেখতে পারেন আসলেই ওখানে কিছু আছে কিনা। আপনি একবার স্ক্যান করালেই সবার কাছে ব্যপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

শফিক সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। স্ক্যন করানো হল। জরুরি ভিত্তিতে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়া গেল। স্ক্যান পিকচারে কোন তেলাপোকার চিহ্নও নেই। শফিক বিশ্বাস করতে পারল না। সে আরও একবার স্ক্যন করাল। ফলাফল একই।

বাড়ি ফিরে শফিক সোজা বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি আটকে দিল। তারপর বহু সময় আর কোন সাড়া শব্দ নেই। ভয় পেয়ে শাহানা গিয়ে বাথরুমের দরোজায় ধাক্কা দিল। ওপাশ থেকে কোন উত্তর এল না। অবশেষে শাহানা গিয়ে উপর থেকে বাড়িওয়ালার ছেলেকে ডেকে নিয়ে এল। দুজন মিলে বাথরুমের দরোজা ভেঙে দেখল শফিকের দেহটা এলিয়ে পরে আছে ভেজা মেঝেতে। শফিকের কাঁধ থেকে রক্তের একটা মোটা ধারা নেমে এসেছে। মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। শফিকের হাতে ধরা একটা রক্ত মাখানো ব্লেড। শফিক নিজের কাঁধ কেটে তেলাপোকাটা বের করে আনার চেষ্টা করছিল।

দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হল। আটটা সেলাই পড়ল। দুই ব্যাগ রক্ত দেয়া হল। শাহানা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। শফিক নির্বাক।

শফিক অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। সারা দিন নিজের মনে বিড়বিড় করে। আর শরীর চুলকায়। ওর হাতের কাছে এখন আর কোন ধারালো বস্তু রাখা হয় না। হাতের নখ একেবারে ছোটছোট করে কেটে দেয়া হয়েছে। এই নখহিন আঙুল দিয়েই সে চুলকে শরিরের কয়েক জায়গার চামড়া তুলে ফেলছে। এই ক’দিনে ওর শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। চেহারাক দেখলে চেনা যায় না। এভাবে অফিস কামাই করে কতদিন চলবে! শফিকের চাকরিটা ভালো, কিন্তু ওর বস এক নম্বরের খাটাশ। শফিককে একটুও দেখতে পারে না। এভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ছুটি নিতে থকলে কবে যেন চাকরি থেকেই ছাটাই করে দেয়। শাহানা একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়। সেও স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে এখন সারাক্ষন শফিকের পাশে। সে রাত জেগে শফিকের পাশে বসে থাকে। ওকে সারাক্ষন চোখে চোখে রাখতে হয়। চোখের আড়াল করলেই আবার কোন অঘটন করে বসে। দুশ্চিন্তা ও রাত জেগে থেকে শাহানার স্বর্ণাবরন মুখটা ফ্যকাসে হয়ে গেছে। তবে এত পাহারা দিয়েও শেষ রক্ষা হল না। চার বছরের নিশি সারাক্ষন বাবার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বাবার শরিরে ঢুকে পড়া তেলাপোকাটা নিয়ে তার আগ্রহের অন্ত নেই। একমাত্র সেই বাবার শরিরে একটি তেলাপোকার অস্তিত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ প্রকাশ করেনি। সারা দিন সে বাবাকে এটা সেটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। বাবা তার বেশির ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দেয় না। তাতে তার আগ্রহের কোন কমতি নেই। এক দিকেলে নিশি বলল, “বাবা তেলাপোকাটা কি খায়?” শফিক খসখসে গলায় বলল, “আমার শরিরের ভেতর থাকে, আমাকেই খায়।” নিশি এবার জ্বলজ্বলে চোখে বলে, “ওটা কে তেলাপোকা মারার ওষুধ খাইয়ে মেরে ফেলা যায় না?” কথাটা শফিকের মাথায় গেথে গেল।

কয়েক দিন ধরেই শফিকের মনে হচ্ছে তেলাপোকাটা তাকে ভেতর থেকে একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে। পোকাটা নরম মাংসে চোয়াল বসিয়ে একটু একটু করে ছিঁড়ে নেয়, সেই জায়গায় তীব্র একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হয়। শফিক দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। নিশির কথাটা তাকে একটা নতুন আইডিয়া দিল। ঘরে তেলাপোকা মারার চকের অভাব নেই। কিছু চক ভেঙে পানির সাথে গুলে খেয়ে ফেললে কেমন হয়। বিষাক্ত চক রক্তের সাথে মিশে চরিয়ে পড়বে শরিরের প্রতিটি শিরায়। তেলাপোকাটা যেহেতু ওর রক্ত মাংস খেয়েই বেঁচে আছে, রক্তের মাধ্যমে বিষ ঢুকে পড়বে পোকাটার শরিরে!!

শাহানা পর দিন বাজার থেকে ফিরে দেখল শফিক অচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। তার মুখ দিয়ে সমানে ফেলা গড়াচ্ছে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হল। প্রায় দুই ঘন্টা জমে মানুষে টানাটানির পর ডাক্তারদেরই জয় হল। দু’দিন পর শফিক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এল। এবার সিধান্ত নেয়া হল তাকে এখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখা হবে, এমন কি বাথরুমে গেলেও চোখের আড়াল করা যাবে না। অবশ্য তার দরকার ছিল না।

সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শে শফিককে কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। সে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকে। যতক্ষণ জেগে থাকে সেই সময়টাও সে একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস করে। তার দিন তারিখের হিসাব গুলিয়ে গেছে। আগের অনেক কথাই সে আর মনে করতে পারে না। একদিন নিশিকে দেখিয়ে সে শাহানাকে জিজ্ঞেস করে এই বাচ্চাটা কে?

শফিক নিজের মনেই বিড়বিড় করে, কখনো হাসে। শফিকের অসুস্থতার খবরটা প্রথম দিকে শাহানা কিছুটা চেপেই রেখেছিল, ইচ্ছে করেই আত্মীয়দের সবাইকে জানায়নি। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন সবাই জেনে গেল শফিকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে সারাক্ষন তার মাথার ভিতর একটা তেলাপোকার সাথে কথা বলে। আত্মীয়েরা দল বেধে দেখতে এল। তারা একেক জন একেক রকমের কথা বলছে। শফিকের এক মামা আছেন বেশ পরহেজগার মানুষ। তিনি বললেন জিনের আসর হয়েছে। এর চিকিৎসা ডাক্তারি বইতে নেই। তার চেনাশোনা ভালো ফকির আছে। তার কাছ থেকে তাবিজ এনে দিলেই এক হপ্তার মধ্যে জিন বাপ ডেকে পালাবে। তাবিজ আনতে দশ হাজার টাকা লাগবে। মামার পিড়াপিড়িতে তাবিজ আনা হল। সেই তাবিজ পরে শফিকের পাগলামি আরও বেরে গেল। ইদানীং তাকে দেখলে চেনা যায় না। অথচ এই চেহারা দেখেই ভার্সিটি পড়ুয়া শাহানার মনে হয়েছিল যেভাবে করেই হোক, এই অসম্ভব রুপবান পুরুষটিকে না পেলে সে বাঁচবে না। শানার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একা বাথরুমের দরোজা আটকে চিৎকার করে ঘন্টা দুয়েক কেঁদে নেয়। সেটা সম্ভব হয় না। এতক্ষন শফিককে চোখের আড়াল রাখা সম্ভব না।

একরাতে অদ্ভুত একটা গিসগিস শব্দে শাহানার ঘুম ভেঙে গেল। সে বাতি জেলে দেখল শফিক ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ করছে, মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে আহআহ শব্দ করছে। শফিক এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমায় ঠিকই, কিন্তু ওর ঘুম কখনই পরিষ্কার হয়না। মানুষটা যে ভীষণ কষ্টে আছে এটা তার ঘুমন্ত মুখেও স্পষ্ট ফুটে থাকে। কিন্তু শফিকের কারনে শাহানার ঘুম ভাঙ্গেনি। অদ্ভুত গিসগিস শব্দটার উৎস খুঁজতে মেঝের দিকে নজর যেতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মেঝেতে অগুনিত তেলাপোকা। যেন কেউ একটা জিবন্ত লাল কার্পেট দিয়ে মেঝে মুড়ে দিয়েছে। তেলাপোকাগুলো সশব্দে তাদের পাখা নাড়ছে, গিসগিস শব্দটা সেখান থেকেই আসছে।

এত তেলাপোকা কোত্থেকে আসল। বাতি জ্বালালে তেলাপোকারা সাধারণত ছুটে আসবাবপত্রের আরালে চলে যায়। কিন্তু এই পোকাগুলো নড়ার কোন লক্ষন দেখাচ্ছে না। শুধু শুন্যে তাদের বাঁকানো শুর তুলে পাখা কাপাচ্ছে। শাহানার মনে হল তেলাপোকাগুলো ওর দিকেই চেয়ে আছে। ওরা যেন শাহানাকে কিছু বলতে চাইছে। হঠাত শাহানার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে হাতে একটা শলার ঝারু নিয়ে উন্মাদের মত তেলাপোকা গুলর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শপাং শপাং ঝারুর বাড়িতে পোকাগুলো চিরে চ্যপ্টা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত কান্ড, পোকা গুলো ছুটে পালাচ্ছে না। যেটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

“মা, কি করছ?” নিশির ঘুম জড়ানো কন্ঠে শাহানার সম্বিত ফিরল। ঘামে তার গায়ের সাথে শাড়ি লেপ্টে গেছে। ঘরময় মড়া তেলাপোকা ছড়িয়ে আছে, ওগুলোর থ্যতলানো গা থেকে কটু গন্ধ বেরুচ্ছে। নিশির ঘুম মাখা চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিশির বাবাও জেগে উঠে বসেছে। জ্বলজ্বলে চোখে সে দেখছে মৃত তেলাপোকাগুলোকে।

***

তেলাপোকাগুলো স্পষ্টই শাহানার পিছু নিয়েছে। সে যেখানে যায় পোকাগুলোও তার পেছন পেছন যায়। যেন ওরা সারাক্ষন শাহানাকে নজরে রাখছে, ওকে পাহারা দিয়ে চলেছে। শাহানার মনে হচ্ছে ওরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একেক সময় শাহানা খেপে গিয়ে খালি পায়েই পকাগুলকে মেঝেতে পিষে ফেলে। পোকাগুলো নির্দ্বিধায় প্রান দেয়, কিন্তু শাহানার পিছু ছারে না।

শফিক এখন একাএকাই শরিরের তেলাপোকাটার সাথে কথা বলে। যতক্ষণ জেগে থাকে পুরোটা সময় পোকাটার সাথে বিড়বিড় করেই কেটে যায়। নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়। এই যেমন কিছুক্ষণ আগে ওরা এভ্যুলুশন নিয়ে কথা বলছিল। মানব শ্রেণী এভ্যুলুশনের শীর্ষে অবস্থান করছে, অথচ মানুষের চেয়ে হাজার বছরের পুরানো হয়েও তেলাপোকা প্রজাতির বিবর্তন এক জায়গায় থেমে আছে। শত উল্কাবৃষ্টি, আগ্নেয়তপাত, আইস এইজ, নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন কিছুতেই তাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা অর্থপ্রোডা শ্রেণীর মধ্যে সবচে রেজিলিয়েন্ট প্রানি। এই রেজিলিয়েন্সির জন্যেই কি তাদের বিবর্তন ত্যগ করতে হয়েছে। অন্যান্য সকল প্রানি যেখানে বিবরতনের মাধ্যমে নিজেকে আরও শক্তিশালী করেছে, নিজের পরিবেশের সাথে নিজেকে আরও খাপ খাইয়ে নিয়েছে সেখানে বিবর্তনহিনতাই তেলাপোকাকে দিয়েছে অনন্ত অস্তিত্বের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এমন যদি হত, তেলাপোকা নিজের রেজিলিয়েন্সি টিকিয়ে রেখেই অন্যান্য দিকগুলতে বিবর্তন ঘটাতে পারত। কিন্তু শত সহস্র বছর যার বিবর্তন থেমে আছে, তীব্র পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তাও যার মিউটেশন ঘটাতে পারেনি সে কিভাবে হঠাত করে নিজের বিবর্তন ঘটাবে। কিন্তু উপায় একটা আছে। সে যদি কোনভাবে বিবর্তনের পথে সবচে অগ্রগামি শ্রেণিটির সাথে নিজেকে মার্জ করতে পারে......

শফিক গোসল করছে। শাওয়ার চলছে। ঝিরঝিরি পানির সহস্র ক্ষুদে বর্শা শফিকের মুখে আঘাত হানছে। ওর বড় ভালো লাগছে। বাথরুমের দরোজা সামান্য ফাঁক করা। দরোজা পুরোপুরি বন্ধ করা নিষেধ। শাওয়ারে ভিজতে ভিজতে শফিক মাথায় হাত বুলাল। একি!! আঙ্গুলের সাথে এক গোছা চুল উঠে এসেছে। পাগলের মত সে মাথায় হাত চালাল আর মুঠিভর্তি করে গোছা গোছা চুল উঠে এল। এসব কি হচ্ছে!! চুল উঠে গিয়ে মাথার এক পাশের নগ্ন তালু দেখা যাচ্ছে। শফিকের বমি পেয়ে গেল। মুখভর্তি করে সে বেসিনে বমি করে ফেলল। বমির সাথে কিছু লাল রক্তও বেরিয়ে এল। শফিক লক্ষ করল হলুদাভ বমি আর রক্তের মিশ্রনে আরও কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, শক্ত একটা কিছু। শফিক জিনিসটা হাতে তুলে আনল।

একটা দাঁত।

শফিক হা করে দেখল মাড়ি থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। মাড়ির ওই জায়গাটায় আঙুল ঢুকিয়ে টানতেই খচ করে আরেকটা দাঁত খুলে এল। ওর চুল দাঁত সব পড়ে যাচ্ছে কেন!? এই সময় শরিরের ভেতর থেকে তেলাপোকাটা খসখসে গলায় কথা বলে উঠল। সে বলল, “সময় হয়েছে”

*

কোমরে একটা তোয়ালে জরিয়ে ভেজা শরিরেই শফিক বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। শাহানা খাটে বসে নিশির একটা ফ্রক সেলাই করছিল। শফিককে দেখে তার হাত থেমে গেল। শফিকের সারা শরীর ভেজা, মাথার একপাশে কোন চুল নেই, চোখের দৃষ্টি উন্মাদের মত।
শফিক এসে শক্ত হাতে শাহানার কাঁধ চেপে ধরল। শাহানা চেচিয়ে উঠল, “এই শফিক কি করছ, লাগছে তো”

শফিক গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে শাহানাকে শুইয়ে দিল বিছানায়। ওর কোমড় থেকে তোয়ালেটা খসে পড়ল মেঝেতে। ভেজা নগ্ন শরীর নিয়ে সে চড়ে বসল শাহানার উপর। শাহানার নিশ্বাস আটকে আসছে। সর্বশক্তি দিয়ে সে শফিককে ঠেলে নামাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু শফিকের শরীরটা যেন পাহাড়ের মত ওর উপর চেপে বসেছে, শত ধাক্কায়ও একচুল নাড়াতে পারছে না। শফিকের আঙুলগুলো লোহার মত শক্ত হয়ে গেথে যাচ্ছে ওর মাংসে। শাহানা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে। কিন্তু পাশের ঘরেই নিশি খেলছে। ঘরের দরোজা ভেজানো, চিৎকার দিলেই নিশি ছুটে আসবে। তাকে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে হবে। শাহানার বুক ধ্বক ধ্বক করছে, মেয়েটা কখন ঘরে ঢুকে পরে! শফিক নির্মম হাতে শাহানার শাড়ি পেটিকোট টেনে নাভির কাছে তুলে ফেলে।

শফিক ওকে রেপ করছে!

*
কেউ একজন ডাকছে।

কে ডাকে?

একটু একটু করে শাহানার চেতনা পরিষ্কার হয়ে আসে। সারা শরিরে প্রচন্ড ব্যথা। শাহানা মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।

কেউ একজন ডাকছে।

আম্মু আম্মু... নিশি ডাকছে। দুহাতে সে মায়ের কাঁধ ঝাকাচ্ছে।

নিশির উপর চোখ পরতেই প্রবল ব্যথা উপেক্ষা করে শাহানা চট করে উঠে বসে। দ্রুত শাড়িটা শরিরে পেঁচিয়ে নেয়।

“আম্মু তোমার কি হয়েছে?” নিশির দুই চোখ ভরা বিস্ময়।

“কিচ্ছু হয়নি আম্মু। তুমি ঠিক আছ?”

“হ্যা, আমার আবার কিহবে? কিন্তু তুমি এভাবে শুয়ে ছিল কেন?”

“এমনি আম্মু, তোমার বাবা কোথায়?” শাহানা দ্রুত ঘরের এদিক ওদিক তাকায়।

“বাবা তো নাই” নিশি জবাব দেয়।

শফিককে ঘরের কোথাও দেখা যায় না। বাইরে থেকে খুব হল্লা শোনা যাচ্ছে। নিশি বারান্দায় গিয়ে দেখল বহু নিচে রাস্তায় অনেকগুলো মানুষ গোল হয়ে জটলা করছে। এই সময় কেউ কলিং বেল টিপল। শাহানা দরোজা খুলে দেখে বাড়ীওয়ালার ছেলেটা। ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল, “আপা একটু নিচে আসেন।”

“কেন কি হয়েছে?” শাহানা জিজ্ঞেস করে।

“জরুরি ব্যপার, আপনি একটু নিচে যান। নিশি আমার কাছে থাক”

শাহানা নিচে গিয়ে দেখল শফিকের থ্যতলানো লাশ রাস্তায় পরে আছে। সে নাকি পাঁচ তলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছে। রাস্তার মানুষ জন দেখেছে।

শাহানা বিস্ময় বা বেদনা কিছুই অনুভব করল না। তার চোখের দৃষ্টি মরা মাছের মত। ও দেখতে পেল শফিকের মাথাটা প্রায় দুই ভাগ হয়ে গেছে। কালো রক্ত জমে আছে জায়গাটায়। সেই রক্তে একটা তেলাপোকা উলটে পরে আকাশের দিকে পা ছুড়ছে।

***

পাঁচ মাস পরের কথা।

শাহানা প্রেগন্যান্ট।

মা’কে সাথে নিয়ে শাহানা ডক্টরের চেম্বারে এসেছে। আজ তার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। পেটের ভেতর বাচ্চাটা একটু একটু নড়ছে। একটু পরেই ওর ছবি দেখতে পাবে, শাহানার ভীষণ ভালো লাগছে।

শাহানার ডাক্তার সেলিনা চৌধুরি। শাহানার নগ্ন পেটে এক ধরনের প্রলেপ মাখানো হল। তারপর সেলিনা ওর পেটে স্ক্যনারটা চেপে ধরলেন। সামনের মনিটরে কাপাকাপা একটা ইমেজ ফুটে উঠল। শাহানার অনভিজ্ঞ চোখে এই অদ্ভুত ইমেজে ওর বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হল না। সে বলল, “ডক্টর, আমার বাচ্চাটা কোথায় তো বুঝতে পারছি না।”

ডক্টর সেলিনা চিন্তিত মুখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কপালে ভাঁজ পড়েছে। এসব কি দেখাচ্ছে! মনিটরটা কি নষ্ট হয়ে গেল!!
নবীনতর পূর্বতন