আমি চিরকাল ধরেই গৃহপালিত জীব।
সবসময়ই চেয়েছি মুক্ত হতে, মুক্ত থাকতে, মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়াতে।
অথচ, বরাবরই আমাকে আবদ্ধ থাকতে হয় গৃহপালিত জীবের মত। স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অর্জন করে নেয়াটা যেন আমাকে দিয়ে হবেই না।
সকাল হলেই তড়িঘড়ি করে অফিসে ছুটে যাওয়া। কারাগারের মত অফিসটার ছোট্ট কামরায় সারাদিনের খাটুনি শেষে সন্ধ্যায় আবার ঘরে ফেরা। ঘরে ফেরার পর আবারো এক রকম বন্দী হয়ে থাকা সকলের মাঝে। নিজ ইচ্ছার প্রাধান্য যেন নেই আমার এই জগতটাতে।
তবে প্রতি সাতদিন পর আমি একবার মুক্ত হই। তা হল ছুটির দিনের পড়ন্ত বিকালটাতে। এই সময়ে আমি আমার আবদ্ধ নীড়ের চুড়ায় উঠে খোলা আকাশটাকে দেখি। ছুটে যাওয়া শুভ্র মেঘগুলোকে দেখে ঈর্ষান্বিত হই প্রতি মুহূর্তে। কিরকম আশ্চর্য এক স্বাধীনতা লুকিয়ে আছে তাদের মাঝে। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায় ওরা। কোন বারণ নেই ওদের, নিষেধাজ্ঞা নেই ওদের উপর।
আমারও ইচ্ছে হয়, এমনি সাদা মেঘের পালকের মত সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতে। মিশে যেতে ইচ্ছে হয় তাদের মাঝে।
তবে, বাস্তবতার সাথে পাল্লা দিয়ে কখনো তা আর সত্য হয়ে ওঠেনা আমার সামনে।
যতই ঈর্ষা হোক মেঘদের দেখে, তবুও তাদের বন্ধু ভেবে গল্প করে কাটিয়ে দেই ঘড়ির কাটায় বেঁধে দেয়া পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সময়গুলো।
২০১৪ সালের মার্চ মাসের ২৮ তারিখ, ছুটির দিন। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তখন বসন্তকাল।
সামান্য সময়ের জন্য মুক্ত হতে ছাদে গিয়েছিলাম। আমি ছাদে গেলে সেখানকার এক সিঁড়িতে বসে থাকি। সেদিন সেখানেই বসেছিলাম।
বিকেলের শেষ প্রান্তে তখন আমি। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। এমন সময় পাশাপাশি অপর এক ছাদে এক মেয়েকে দেখে নিজ অজান্তেই দাঁড়িয়ে গেলাম।
বুঝিনা, এটা কি আসলেই এক রকম চারিত্রিক ব্যর্থতা? হয়তো হ্যাঁ, অথবা না...
নিজেকে সামলে নিয়ে বসে পড়লাম নিজ আসনে।
আমার এই উদ্ভট আচরণটা মেয়েটির চোখে পড়েনি হয়তো।
এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। নয়তো সে নিজে নিজে আমাকে নিয়ে কি ভাবতো, কে জানে...!
আরও একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাকে দেখার পরপরই মুখ থেকে বিড়বিড় করে কবিতা কিসিমের কিছু বাক্য বের হতে লাগলো।
কি এক অস্বাভাবিক আচরণ আমার মাঝে। নিজেকে ভেবে লজ্জিত হলাম অনেকটাই। এর আগে এমনটা হয়নি কখনো।
কখনো প্রথম দেখাতে প্রেমে পড়িনি কারো। সেদিন বুঝি পড়েই গিয়েছিলাম। আর, না পড়ে উপায়ও নেই। মেয়েটা দেখতে ছিল তেমনই। খুব শান্ত হয়ে একাকী দাঁড়িয়েছিল ছাদের রেলিং ধরে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নীল আকাশটার মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছিল কিছু একটা। আমার শীতল দৃষ্টি যেন তার থেকে নামতেই চায় না।
সন্ধ্যার প্রকৃতি আমার কাছে এক স্বর্গের মত। অথচ, মেয়েটিকে দেখার পর সেই স্বর্গটাও নিতান্ত তুচ্ছ মনে হল। কি এক অদৃশ্য অদ্ভুত অনুভূতি।
পাশাপাশি দুটো ছাদে আমরা এই দুটি প্রাণী ছাড়া আর কেউই ছিলনা। আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ততক্ষণ, যতক্ষণ সে সেই ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল।
আরেকটা কথা। শুধুই আমি একা দোষী না, আড়চোখে সেও তাকিয়েছিল আমার দিকে। ব্যর্থতা একটাই, রমণীর নামখানা জানতে পারিনি।
তাকে দেখার পর বিড়বিড় করে যেসব বলেছিলাম, বাসায় এসে সেগুলোকে সাজাতে বসলাম। যেন অগোছালো এই আমাকেই সাজিয়ে যাচ্ছি নতুন করে।
বালিকা...
আমি কি আরেকবার যুদ্ধে যাবো?
হেরে যাওয়া কোন বীরের মতো
দ্বিতীয়বার যুদ্ধে যাবার উন্মত্ত আশায়।
নাকি এখানেই থেমে যাবো?
যুদ্ধে পরাজিত বীরের মতো।
যদি হারিয়ে যাও?
যদি কেউ তোমায় ছিনিয়ে নেয়?
যদি তার শক্ত বাহুতে মাথা রাখো তুমি?
হারাবো, আমি হারাবো দ্বিতীয়বার।
শেষ বিকেলের স্বপ্নটাও চূর্ণ হবে আরেকবার।
বালিকা...
আমি কি আরেকবার কবি হবো?
ছন্দ ফিরে পাওয়া কোন ব্যর্থ কবির মতো
দ্বিতীয়বার কলম ধরার নতুন প্রেরণায়।
নাকি আবারো অবসর নেবো?
কলম আর পুরনো ডায়েরি থেকে।
যদি আড়াল হও?
যদি কেউ তোমায় নিয়ে কবিতা লেখে?
যদি তার কবিতায় মুগ্ধ হও তুমি?
হারাবো, আমি হারাবো দ্বিতীয়বার।
শেষ বিকেলের স্বপ্নটাও চূর্ণ হবে আরেকবার।
এটা আসলেই বোকা কিসিমের একখানা কবিতার মত। এ কবিতার একটি চরণের সাথে অন্য চরণের কোন মিল নেই। তাই একে কবিতাও বলা যাবেনা। আর, যাবেই বা কেন? আমি তো আর কবি না। স্রেফ একজন অকবি, যে কিনা কবিতার সঙ্গটাও জানেনা।
আচ্ছা... বালিকা কি আমাকে নিয়ে এরকম কিছু ভেবেছে? যা আমি এখনো ভেবে যাচ্ছি বিরামহীন...
পরের কোন এক সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
ইংরেজি মে মাসের ০৯ তারিখ। বৈশাখের শেষ দিকের সময়।
দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় জীবন যেন তার ক্লান্তি-সীমার শেষ প্রান্তে। তপ্ততার সাথে ঝগড়া করে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। টেরই পাইনি, কখন যে বিকাল হয়ে গেছে।ঘুম ভাঙ্গলো ছোট ভাইয়ের নাক ডাকানিতে। ক্ষিপ্ত হয়ে রাগের বশে তার সুখনিদ্রাতে পানি ঢেলে দিলাম।
ঘুম ভাঙ্গার পর হাসিবকে তার মক্তবে পৌঁছে দিয়ে আমি গেলাম আমার নীড়ের চূড়ায়। সকাল থেকেই খোলা আকাশটার কথা মনে পড়েছিল বারবার।
যাই হোক, ছাদে উঠতেই দেখা মিলল বসন্ত বিকেলের সেই বালিকার। দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় পরে আবার দেখা। আমি কখনোই ভাবিনি, ফের তার দেখা পাবো।
নিজেকে কেন জানি অপ্রস্তুত মনে হল তখন।
ছাদের সেই সিঁড়িতে বসে সাদা মেঘগুলোকে দেখতে লাগলাম। চোখ যেন তার বাঁকা দৃষ্টিতে মাঝে মধ্যে তাকিয়ে থাকে সেই বালিকার পানে।
আজ সে বালিকা একা নয়। তার সাথে ছোট ছোট আরও দুই মেয়ে। গল্প করছে তিনজনে মিলে। কখনোবা হাসিতে ফেটে পড়ছে একসাথে। সেই হাসি আমার দৃষ্টিকে তার দিকে বেশি করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সেদিনের প্রকৃতি থেকে আজকের প্রকৃতি যেন অনেক আলাদা। শান্ত মেয়েটি আজ খুবই চঞ্চল। মেয়েটা একটু পরপরই তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। একটু হাসে, আবার থেমে থাকে। যখনই তার দিকে চোখ পড়ে, তখনই সে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে। এভাবে কোন এক সময় সে আমার দিকে একনাগাড়ে প্রায় এক মিনিট ধরে তাকিয়েছিল।
দেখে মনে হচ্ছিল, সে আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। হয়তো কোন এক বাধায় সে আমাকে বলতে পারছে না।
তার চাহনিতে আমি এতটাই বিব্রত-বোধ করেছিলাম যে, আমি আমার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে পাশের দালানের দশ বছরের এক ছেলেকে ডেকে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।
ছেলেটার নাম সোহাগ। আগে কখনো দেখিনি তাকে। এই প্রথম দেখা হল তার সাথে। সোহাগের সাথে পরিচয়ের পর তার হাতে কাগজ দেখে আরেক দ্বার উন্মুক্ত হল আমার সামনে। কাগজের নৌকা বানানোর ভুতটা যেন মাথায় চেপে বসলো সহসাই। ওর থেকে কাগজ নিয়ে নৌকা বানালাম।
এ সবই মেয়েটি দেখেছিল। এরপরে একটা কাগজের উড়োজাহাজ বানিয়ে ছুড়ে দিলাম সোহাগের দিকে। বিপরীতমুখী বাতাসে সে উড়োজাহাজ পুনরায় আমার কাছেই এসে ভিড়লো। এমন সময় অপর পাশের ছাদ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। সেই হাসি অন্য কারো নয়। শেষ বিকেলের সেই মেয়েটির।
আমার এরূপ ব্যর্থতা তার চোখে পড়তেই বুঝি সে এতটা হেসেছিল। যাই হোক, সোহাগের সাথে গল্পে গল্পে আর তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মেয়েটির হয়তো তখন নেমে যাওয়ার পালা। একটু পরে সে ঐ দুটো মেয়েকে রেখে একা একা নিচে নেমে আসলো। শুকনো কাপড় গুছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিঁড়ির গোঁড়ায়।
আমি সব আড়চোখে দেখছিলাম। চেয়েছিলাম, বিদায়ের বেলা সরাসরি তাকিয়ে থেকে তাকে ভালভাবে দেখবো। যেই না তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, অমনি সে হাত নেড়ে আমায় একটু ইশারা করেই সামনের হাঁটা শুরু করে দিল। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এখানেই শেষ নয়, খানিক পরে সে একবার পিছু ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসেই চলে গেল। আমিও একটু হেসেছিলাম। হয়তো সে হাসি তার চোখেই পড়েনি। আমাকে ইশারা করবে বলেই হয়তো সে ছাদের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ইশারা এখনো আমার চোখে ভাসে প্রতি মুহূর্তে।