মহৎ প্রাণের অস্তিত্ব
কালের ধারাবাহিকতায় তখনও সাময়িক সময়ের জন্য জন্ম হয়নি রবিকরের। পূর্বাকাশে সুপ্ত থেকে জন্ম নেবার অপেক্ষায় যেন অস্থির সে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই হয়তো রেগে-মেগে রক্তরাঙা হয়ে দেখা দেবে ঐ পূব আকাশের এক কোনে। লাঙল নিয়ে রুক্ষ প্রান্তরে ব্যস্ত থাকা স্বর্নচাষীর ঘাম ঝরিয়ে পড়ন্ত বিকালে ক্ষান্ত হবে সে।
ভোরের আলো স্পষ্ট হওয়ার অনেক আগেই যান্ত্রিক তরী পৌঁছে গেছে তার শেষ গন্তব্যে। প্রিয়জনের টানে ঘরে ফেরা মানুষদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। কার আগে কে নেমে যাবে, এই নেশায় তাদের প্রতিযোগিতা যেন শেষ হতেই চায় না।
ভীর কমে গেলে লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে নিরু। বাসস্ট্যান্ডের পথে একা হেটে যাচ্ছে সে। চারদিকের নিঃশব্দ প্রকৃতি এখন আঁধারের কালো চাদর মুরি দিয়ে আছে। যেন মনে হয়, থমকে আছে ঘড়ির তিনটে কাঁটা। রাত্রি জাগরিত কুকুরের ডাক মাঝে মাঝে ভেঙে যায় শহুরে নীরবতা। পিচ-ঢালা শীতল পথ। এমন নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ পথ পুরোটাই একা হেটে পাড়ি দিতে চায় নিরু। হয়তো অন্য রকম এক অনুভূতি লুকিয়ে আছে এর মাঝে।
কিছুদূর হাটতেই ষাটোর্ধ একজন রিকশাওয়ালা তার রিক্সা থামিয়ে নিরুকে বললো,
- কোথায় যাবেন?
- বাসস্ট্যান্ড।
- আসুন আমার সাথে।
- না, আমি হেঁটেই যাবো।
- অতদূরে হেটে যাবেন কেন? উঠুন রিক্সায়।
- আমার হাটতেই ভালো লাগে।
- সবখানে ভালো লাগাতে নেই। দিনকাল ভালো না।
- আমি হাঁটবোই। দয়া করে বিরক্ত করবেন না।
- আচ্ছা, ভাড়া কম দিয়েন। তবুও চলেন।
নিরু বুঝতে পারল,লোকটা আসলে ছাড়বার পাত্র না। তাই ফন্দি করে বললো,
- ভাড়া কত?
- চল্লিশ টাকা।
- দশ টাকায় যাবেন?
- উঠুন।
নিরু অবাক হল। লঞ্চঘাট থেকে বাসস্ট্যান্ড এর ভাড়া কমপক্ষে ৩০ টাকা। এত কম ভাড়ায় সে কেন রাজি হবে? মনে মনে ভাবলো, কোন কুমতলব আছে হয়তো...
তবুও কথার জালে আবদ্ধ হয়ে রিক্সায় উঠে বসল নিরু।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল করল, মূল রাস্তা রেখে রিকশাওয়ালা অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছে।
- এদিক দিয়ে যাচ্ছেন কেন?
- বুঝবেন না। চুপ থাকেন। আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিলেই তো হয়।
নিরু নীরব থেকে সিগারেট ফুঁকতে লাগল। একটা ভয় কাজ করছে তার মাঝে।
কিছুদূর যেতেই কয়েকজন লোক পথ আগলে দাড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল।
- সোবাহান চাচা, ইনি কে?
- আমার ছেলে।
- আগে তো দেখিনি কখনো।
- ও ছোটবেলা থেকেই মামাবাড়িতে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য এসেছে।
- ঠিক আছে চাচা, যান।
বৃদ্ধ পায়ের শক্ত পেশির জোরে রিক্সার চাকা তিনটি আবার গড়িয়ে চলে আঁকাবাঁকা পথের ধুলোয়। নিরু জিজ্ঞেস করল,
- চাচা, ওরা কারা?
- ছিনতাইকারী।
- ওদের কাছে আমাকে আপনার ছেলে হিসেবে পরিচয় দিলেন কেন?
- নয়তো ওরা আপনার সবকিছু নিয়ে যেত।
- ওদের কে আপনি চিনেন?
- চিনি বলেই তো আপনাকে এই রাস্তায় নিয়ে এসেছি। আপনি যদি একা হেটে আসতেন, তাহলে নির্ঘাত বিপদে পরতেন। আর, এমনটা আমি চাইনি। চাইবোই বা কেন, আমরা যে সকলেই মানুষ। তাছাড়া, আপনার মত আমার এক ছেলে ছিল।
- এখন নেই?
- না।
- কি হয়েছে তার?
- রাজপথের শ্রমিক আন্দোলন ওকে আমার কাছে আর ফিরে আসতে দেয়নি। ওই বাম দিকে যে চৌরাস্তার মোড়, ওখানেই ওর স্মৃতিস্তম্ভ। শহরের প্রতিটি পথঘাট যেন ওই স্তম্ভের পটভূমি বহন করে আছে। আর, প্রতি সন্ধ্যায় তার শ্রদ্ধায় মাথা নত করে রাখে এ শহরের সমস্ত সবুজ গাছ।
- এরকম সংগ্রামী নেতার বাবা হয়েও এই বয়সে আপনি রিক্সা চালান?
- আমার আপন বলতে এই রিক্সা ছাড়া আর কেউ নেই। ঘরবাড়ি সবই ছিল। তোমার চাচীর চিকিৎসায় তাও গেঁথে গেছে হাসপাতালের প্রতিটি শক্ত ইটের মাঝে। দারিদ্র্যের বোঝা যে কতখানি ভারী হতে পারে তা আমি বুঝি। আর, তার নির্বাক সাক্ষী হয়ে সাথে সাথে ঘুরে বেড়ায় আমার এই তেপায়া মানবযান।
- আফসোস! দেশ আপনার জন্য কিছুই করেনি?
- মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এখনো কিছুই পাইনি। ভেবেছিলাম দূরে কোথাও চলে যাবো, পারিনি। যে শহরের বুকে আমার একমাত্র সন্তান ঘুমিয়ে আছে, সে শহরের অদৃশ্য মায়ার সাথে যুদ্ধ করে আমি হেরে যাই প্রতি মুহূর্তেই। কষ্টকে আগলে রেখে থেকে যাই আমার ছোট্ট কুঁড়েঘরে, যার প্রতিটি কুটোয় বেঁধে আছে স্মৃতিবিজড়িত সকল সুখ।
- খুব নির্মম সুন্দর আপনার কথাগুলো।
সরু রাস্তা পেড়িয়ে রিক্সা তখন প্রধান সড়কে। এমন সময় সড়কের হলদে আলোয় নিরু খেয়াল করল, রিকশাওয়ালার ডান হাতটা নেই। নিরু কারণ জিজ্ঞেস করলে রিকশাওয়ালা উত্তর দিল,
- হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম। যুদ্ধের সময় স্কুল বন্ধ করার হুকুম আসলেও দেশ তথা তোমাদের স্বার্থে আমি স্কুল খোলা রেখেছিলাম। ওরা আমাকে ব্লাকবোর্ড-এর সামনে থেকে টেনে নিয়ে আমার লেখার গতি থামিয়ে দিল। ডান হাতে রাখা সাদা চকটা লাল হল মুহূর্তেই।
- আপনি আমার সাথে যাবেন?
- কোথায়?
- সবসময় আমার সাথেই থাকবেন।
- মৃত্যুর পরে যেথায় খুশি সেথায় নিয়ে যেও। আপত্তি নেই। তার আগে এ শহর ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।
এরূপ কথোপকথনে রিক্সা বাসস্ট্যান্ড-এর কাছাকাছি এসে একটা চায়ের দোকানের সামনে থামল।
- আপনি এখানেই নামুন। বসে বসে চা খান। সকাল হলেই বাসস্ট্যান্ড যাবেন। হেটে গেলে মাত্র এক মিনিটের পথ। এখন যাওয়া ঠিক হবেনা। ভাড়া দিন, যেতে হবে।
রিকশাওয়ালা দশ টাকা চাইলেও নিরু তাকে চল্লিশ টাকা দিতে মোটেও কার্পণ্য করল না। টাকা না গুনেই তা ছেড়া পাঞ্জাবির পকেটে রেখে রিকশাওয়ালা চলে গেল।
কত বড় মনের মানুষ হলে তার দ্বারা এরূপ মহান কাজ সম্ভব। এত বড় মহৎকর্ম করেও তার বিনিময়ে কিছুই চায়নি সে। সামান্যতম অহংকারও নেই তার মাঝে। তাছাড়া কত বৈচিত্র্যময় তার জীবন। কত উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়ে আজ সে জীবনের এই কঠিন-তম ক্রান্তি-লগ্নে। এরকম কিছু মহৎ প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলেই হয়তো পৃথিবী এখনো এত সুন্দর। এসবই ভাবতেই আনমনা হয়ে বৃদ্ধের পথে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকলো নিরু।
- এই নিন আপনার চা।
দোকানদার তার চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিলো নিরুর দিকে।
- সোবাহান চাচাকে আপনি চিনেন?
- নিশ্চয়ই সে আপনার মন জয় করে নিয়েছে। তাইনা?
- হুম।
- মানুষটা সারাজীবনই একরকমই থেকে গেল। এই মাঝরাতে যারাই আমার এখানে আসবে, তাদের অনেকেই সোবাহান চাচার গুণগান গাইবে। কোন না কোন একদিন সে হয়তো সোবাহান চাচার কবলে পড়েছিল।
এদিকে নিরুর মন সেই বৃদ্ধ মানুষটার অস্তিত্বে ডুবে গিয়েছিল।
- চা খেয়ে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আর, কোথায় যাবেন আপনি?
অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে নিরু বললো,
- কুয়াকাটা।
- কিছুক্ষণ পরেই কুয়াকাটার পথে প্রথম গাড়ি ছেড়ে যাবে। আপনি আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যান। এখন আর কোন সমস্যা নেই। সমস্যার সব পথ আরও বহু আগে পাড়ি দিয়ে এসেছেন সোবাহান চাচাকে সাথে করে।