শুনেছি প্রত্যেকটা মেয়ের জন্যই বিয়ের প্রথম রাত নাকি স্বপ্নের রাত, স্মরণীয় রাত। আমিও এমন একটা রাতে ঘোমটা টেনে নতুন বউ হয়ে অপেক্ষা করেছিলাম উনার। কিন্তু তিনি আসেন নি, এসেছেন আমার নতুন মা মানে শ্বাশুড়ি। একটা ফুটফুটে জ্বলজ্যান্ত পুতুল আমার হাতে তুলে দিয়ে শুধু বলেছিলেন, “মা! আমার ছেলেটাকে জয় করার দায়িত্ব শুধু তোমারই, যদি হেরেও যাও এই বাচ্চাটার মা হয়েই না হয় চিরকাল থেক!”
হুম, রাতটা অন্যদের মত না হলেও ছিল স্মরণীয়। বিয়ের প্রথম রাতেই যে আমি মা হয়েছি। অবশ্য এতে আমার কোন আপত্তি ছিল না, আমি সব জেনে শুনেই বিয়েটা করেছি। একজন নারীর জীবনে শ্রেষ্ঠ রাত কাটিয়ে দিলাম মা হওয়ার দায়িত্ব নিয়েই। বিয়ের পর অনেকদিন উনি আমার পাশে ঘুমান নি। প্রয়োজন ছাড়া আমার রুমেই আসতেন না। শেষে আম্মার জোরাজোরিতে এসে ঘুমাতে লাগলেন কিন্তু একখাটে ঘুমালেও দেওয়াল হয়ে ছিল একটা কোলবালিশ। তিনি যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখম তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শুধু দেখতাম আর ভাবতাম কিভাবে মানুষ বদলে যায়! যিনি আমার পাশে শুয়ে আছেন, মানে আমার স্বামী, তিনি আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। অনেক হাসিখুশি থাকতে দেখতাম। আমরিন আপুর সাথে তাকে বেশ মানাতো।
মাঝেমধ্যে আমিও ভাবতাম, ইস! মানুষ এতোটা কাউকে ভালোবাসতে পারে কি করে? আমারও যেন এমন একটা বর জুটে। হ্যা, আমার দোয়া যেন কবুল হয়েছে। তার মত না তিনিই আমার বর হলেন। লোকটা কতটা বদলে গেছে। হাসতে দেখি না অনেকদিন। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে আমরিন আপু মারা যান। লোকটাকে হাউমাউ করে বাচ্চার মত সেদিন কাঁদতে দেখেছি, ইচ্ছে করেছিল তার কাছে গিয়ে একটু স্বান্তনা দেই। কিন্তু যেতে পারিনি, দিতে পারি নি স্বান্তনা। তার উপর যে সেদিন আমার কোন অধিকার যে ছিল না। আজও লোকটা কাঁদে, ওই আমরিন আপুটাকে মনে করেই কাঁদে। আমি শুধু শুনি, কিন্তু আজ অধিকার থাকা সত্ত্বেও পাশে যাই না। ভয় হয়, যদি অনধিকার চর্চা হয়ে যায়? তিনি তো আমাকে নিজের বউ করে আনেননি এনেছেন নিজের সন্তানের মা করে।
খুব হিংসা হয় আমরিন আপুকে ভাবলে। তিনি আজ না থেকেও আমার জায়গা নিয়ে আছেন। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। কারো স্ত্রী হতে না পারলেও ভালো একজন মা হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার সন্তান আজ আমার সন্তান হয়ে গেছে। পেটে না ধরলেও মা হওয়া যায় তা ‘অমরের’ প্রথম মা ডাকেই বুঝেছি! হ্যা, আমার সন্তানের নাম আমি নিজেই রেখেছি, আমরিন আপুর নামের সাথে মিল করেই রেখেছি ‘অমর’।তিনি বেঁচে থাকুক আমার সন্তানের নামে।অমর হাঁটতে শিখেছে। মা মা বলে গুটি গুটি পায়ে যখন আমার কাছে দৌঁড়ে আসে মনে হয় আমার ছোটবেলা যেন ফিরে এসেছে।
আমাদের মা ছেলের খুনসুটি তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন, হাসতেন। তার ওই হাসির প্রেমে প্রত্যেকদিন পড়তাম। প্রহর গুনতাম তাকে নিজের করে নিতে। আবার অনুশোচনাও হতো, আমরিন আপুকে ভাবলে! তাই আর কাছে যাওয়া হতো না! এখন অমরের হাসির সাথে আরেকজনের হাসিও শুনতে পাই। মনের মধ্যে গেঁথে আছে সেই হাসি। এখন তিনি অফিসে যাওয়ার আগে নিয়ম করে জিজ্ঞাসা করেন “বাচ্চার মায়ের কিছু লাগবে?” প্রথম প্রথম লজ্জায় না বললেও এখন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে বলি। কারণে অকারণেও আবদার করি। তিনিও সকল আবদার সানন্দে পূরণ করেন। তবে জানি না কার ইচ্ছে পূরণ করেন? নিজ সন্তানের মায়ের, নাকি নিজের স্ত্রীর! জানতেও চাই নি কোনদিন, প্রয়োজন নেই জানার। কারণ যেটাই হোক তিনি তো আমারই।
এখন আমাদের মাঝের দূরত্ব অনেকটা কমেছে। বিছানায় কোলবালিশের দেওয়ালটা আজ আর নেই। তবুও তিনি আজও স্বামী হয়ে আমার সামনে আসেন নি, আমাকে স্বামীর ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দেন নি। বড্ড রাগ হয় লোকটার উপর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি সুন্দরী নই? আমাকে আমরিন আপুর শাড়িতে আমরিন আপুর মত লাগে না? আমাকে আমরিন আপু ভেবেই কি একটু ভালোবাসা যায় না! আমারও তো ইচ্ছে জাগে আপনার বুকে মাথা রেখে প্রতিটা রাত ভোর করতে। ইচ্ছে করে স্বামীর ছোঁয়ায় নারী থেকে স্ত্রী হতে!”
একদিন উনার খুব জ্বর হলো, কেন যেন মনে হচ্ছিল তার জ্বরের তাপ আমার হৃদয়টাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। সেদিন রাতে চোখের পাতা দুটো এক করতেই পারলাম না! সারারাত তার সেবা করে জেগে রইলাম, শুধু সেবিকা হয়ে না তার স্ত্রী হয়েই। যখন একটু সেরে উঠলেন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে শুধু বললেন, “আমার যদি কিছু হয়ে যায় এভাবে সারাজীবন আমার সন্তানের মা হয়ে থাকবে তো?” কথাটা শুনে নিজেকে সেদিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না, অঝোরে তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে লাগলাম, লজ্জা সেদিন হয়তো আমার কান্না হয়ে সেদিন ঝড়ে পড়েছিল।
-“আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও আপনি তো আমার প্রথম আর একমাত্র স্বামী। কোথায় ছেড়ে চলে যাবেন? এখনো তো আপনার স্ত্রী হওয়াই হলো না!” লোকটা কিছু বলেন নি, শুধু জড়িয়ে ধরেছিলেন যেমন ভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। সেদিনই প্রথম তার ছোঁয়ায় নিজেকে উনার স্ত্রী মনে হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে হাসি আনন্দে অনেকটা বছর। তিনি আজ লোকটা থেকে হয়েছেন আমার স্বামী! দেখতে দেখতে আমার অমরটাও পাঁচ বছরের হয়ে গেল। না, আমার না! আমাদের অমর! তবে এখন সে একটু রেগে আছে আমার উপর। আগের মত আমাকে যে জড়িয়ে ধরতে পারে না, আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে পারে না।
-আব্বু! আম্মু কি আর আমার সাথে খেলবে না?
-কেন খেলবে না বাবা? আর ক’দিন পরেই খেলবে!
-এখন একটু খেললে কি হয়? বাবা আম্মুকে বল না খেলতে!
-এতো বড় পেট নিয়ে খেলতে গিয়ে যদি তোমার আম্মুর কিছু হয়ে যায় তখন তোমাকে বোন দিবে কি করে?
-না আব্বু, আমার বোন চাই না, স্কুলে দেখি মেয়েরা শুধু ঝগড়া করে! আমার ভাইয়া চাই।
-হ্যা, অমর। একদম ঠিক! আমারও কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার একটা ভাইয়াই হবে।
-সত্যিই আম্মু? ইয়ে! তুমি অনেক ভালো। (বলেই জড়িয়ে ধরে আমাকে, হ্যা নিজের মাকে।আমিও আমার পাগল ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রাখি।)
অমরের বাবা আর কিছু বলেন না, তার শুধু একটাই চাওয়া। ছেলে/মেয়ে যেই আসুক যেন অমরের ভাই/বোন হয়েই আসে। আমিও মা মরা মেয়ে, খুব ছোটকালে মাকে হারিয়েছি। বাবা নিজেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, যদি অনাদর হয় তাই আত্মীয় স্বজনের শত চেষ্টায়ও বিয়েতে রাজি হন নি। তিনিও ভরসা করে উঠতে পারেন নি কোন সৎ মায়ের উপর আমার দায়িত্ব দিতে। আমি মা মা করে খুব কাঁদতাম। বাবাকে খুব বলতাম আমাকে একটা মা এনে দাও। একটু বড় হয়ে বুঝলাম কেন বাবা আমাকে মা এনে দেন নি।
তাই আমি বুঝি মা হারা সন্তানের কেমন লাগে! বিয়ের দিন বাবা শুধু বলেছিলেন “ মা! তুই আমার এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করিস না! তোর স্বামী যেন কোনদিন এই কথা না বলে, পেটে না ধরলে মা হওয়া যায় না।” মায়ের অভাবে আমার ছোটবেলা যেমন কেটেছে অমরের ছোটবেলা যেন তেমনভাবে না কাটে সেই জেদ নিয়েই সেদিন অমরের মা হয়ে এসেছিলাম। বাবা তোমার কথা আমি রেখেছি। আসলেই মা হতে কাউকে গর্ভে ধারণ করতে হয় না। তাইতো আজ অমরের সাথে অমরের বাবাকেও স্বামী হিসেবে পেয়েছি।।