বিষকন্যা



কোনো-ভাবেই যখন সুকন্যার বাজে কথা বলা আর পরশ্রীকাতরতার প্রবল স্রোতকে দমানো গেল না তখন তার আশে-পাশের লোকজন,আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধবরা ভীষণ রকম হতোদ্যম হয়ে পড়ল।আসলে এই দমে না যাওয়াটা যে সুকন্যার মানসিক ব্যাধি সেটা ওর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর আত্মীয়রা বেশ ভাল বুঝতে পারছিল।কিন্তু সুকন্যা নিজে এই কথাটা মানতে নারাজ।তাই বেশ কিছুদিন ধরে ভোটের প্রচারের মতো সুযোগ পেলেই বরের প্রচার করাটা তার একটা ভয়ানক রোগে পরিণত হয়েছিল।এর সঙ্গে দেখা দিয়েছিল বানিয়ে কথা বলার এক মারাত্মক প্রবণতা।সম্পূর্ণ কাল্পনিক জগতে ও বাস করছিল।সকালে একরকম কথা বলে তো বিকেলে আর একরকম কথা বলে।এর কাছে ওর নামে আবার ওর কাছে এর নামে বলে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল।ফলে আস্তে-আস্তে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবহীন হয়ে একটা একাকী দ্বীপের মধ্যে বাস করছিল ও।তখন এমন অবস্থা হয়েছিল যে সুকন্যার ফোন এসেছে অথবা সুকন্যা কারো বাড়ী যাচ্ছে একথা শুনলেই সকলের মনে সাঙ্ঘাতিক ধড়ফড়ানি শুরু হতো।

সুকন্যার সকালটা শুরু হতো এইভাবে-

”হ্যালো কে পরমা?”

”হ্যাঁ সুকন্যা তাড়াতাড়ি বল একটা মিটিং এ আছি।”

”শোননা অতসীর অ্যানিভার্সারিতে আমি কিন্তু যেতে পারব না।আমার অসুবিধে আছে।আর সোমার গাড়ীতে আমি কিছুতেই যাব না।ওর বড্ড বড়লোকি চাল।”


”ঠিক আছে যাবিনা। সবাই যে সব জায়গায় যাবে তার কি কোনো মানে আছে?আর এইটা বলার জন্য তুই এই সাতসকালে ফোন করলি?উফফ্ পারিসও বটে।তুই এখন রাখ।আমি একটা জরুরী মিটিং এ আছি।”

”শোননা পরমা, শোননা, একটু কথা বলা যাবে না?তোরা কে কে যাচ্ছিস?তোরা কি সোমার গাড়ীতেই যাবি?”

পরমা বিরক্ত হয়ে খট্ করে ফোনটা কেটে দিল।একটু পরেই আবার-

”হ্যালো কে সুতপা?কি করছিস?”

”এই তো কলেজ যাচ্ছি।আজ থেকে পরীক্ষার ডিউটি।খুব তাড়াহুড়ো রে।যা বলবি তাড়াতাড়ি বল।”

”তোরা ব্যস্ত মানুষ।সেজন্যই ফোন করে বিরক্ত করিনা।জানিস তো পরমার খুব অহঙ্কার! ফোন করলাম।খট্ করে ফোনটা কেটে দিল।আসলে জীবনে শান্তি নেই।পুরো নাটক করে চালাচ্ছে।গাড়ী-বাড়ী থাকলেই শান্তি থাকেনা।অতসীর বাড়ী যাব না বললাম কিন্তু একবারও বলল না চল।—-উল্টে ফোন কেটে দিল।আমি কাউকে অতো তেল দিয়ে চলতে পারব না।—তোর পয়সা তোর আছে।—আমার বরকে বললেই গাড়ীতে ছেড়ে দিয়ে আসতো।এইতো কদিন আগে আমার জন্যই গাড়ী কিনলো।ও তো ভীষণ কেয়ারিং।জানিসই তো আমাকে কি ভালোই না বাসে।বন্ধুদের ব্যাপারে আমাকে জড়াতে না করেছিল তাও—–।”

একটানা আগডুম বাগডুম বকে চলে সুকন্যা।ততক্ষণে সুতপা ফোন উল্টে রেখে দিয়েছে।কলেজ বেরোনোর সময় এত বাজে বকার সময় নেই ওর।

”হ্যালো–‘হ্যালো—যাহ্ বাব্বা ফোনটা কেটে গেছে।”

নিরুৎসাহ হয়ে ফোনটা কেটে দিল সুকন্যা।

”হ্যালো কে শান্তা?”

”কি করছিস রে?”

”এই যে একটু পরে বেরোবো।একটা এসি কিনব রে আজ। বড্ড গরম তো আর পারছি না।”

শান্তা চটজলদি উত্তর দেয়।সাথে-সাথে সুকন্যা বলে ওঠে-

”আমার বর তো আমাকে বলেছিল এসি কিনে দেবে কিন্তু আমি না করলাম।এসির হাওয়া আমার একদম ভালো লাগে না।বাত হয় জানিস তো এসিতে?”

”বাত হয়? কে বলল তোকে?গরমে এসিতে না থাকাটাই আরও খারাপ।বিশেষত যাদের প্রেসার আছে।আমাকে তো ডাক্তার বলে দিয়েছে খুব গরমে এসিতেই থাকতে।আচ্ছা এখন রাখছি রে ।আমার গাড়ী এসে গেছে।”

শান্তা ফোন রেখে দেয়।

সুকন্যা মনে-মনে ভাবে-

” হুঁ! গাড়ী আছে শোনাচ্ছে।গাড়ী এসে গেছে।গাড়ী যেন আর কারো থাকে না!এসি কিনতে যাচ্ছিস যা।এতো চালবাজি কিসের?”

একটুও উৎসাহ না হারিয়ে সুকন্যা ফেসবুকে কয়েকটা জ্ঞানগর্ভ পোস্ট করে দেয় চট করে।এক নম্বর- যৌবনে কাকও সুন্দরী।দুনম্বর- সময়ে মানুষ চেনা যায়।তারপর তিন নম্বর-অহঙ্কার পতনের মূল ইত্যাদি।মনটা অস্থির-অস্থির করছিল ওর।মনে- মনে রোজকার মতই একরাশ ভাবনা এসে জড়ো হলো। আজ যদি সুকন্যা স্বার্থত্যাগ না করতো তাহলে কতজনের বড়লোকি চাল বেরিয়ে যেত।গুগল খুলে এসির অপকারিতা সম্বন্ধে কয়েকটা লিঙ্ক ও শান্তাকে পাঠিয়ে দিল তাড়াতাড়ি।তলায় লিখল-

”এটা পড়।”

শান্তা ছাড়াও আরও কয়েকজনকে এই লিঙ্কগুলো পাঠালো।যারা সারাদিনই প্রায় এসির আরামে থাকে।তাদের উদ্দেশ্যে লিখল-

”এটা পড়।বা এটা পড়ুন।”

সকালটা মোটামুটি এইভাবেই কাটে সুকন্যার।এইরকম স্বভাবের জন্য সকলেই যে ওর ওপর বিরক্ত হয় এইটা কেন যে বোঝেনা কে জানে।ওর একটা ছেলে সৌরভ পড়াশোনা করছে।ক্লাস টুয়েলভ। সে তো সকাল থেকে বেরিয়ে যায়,কোচিং -টোচিং সেরে ফেরে রাতে।বর চাকরি করে। সে ও সারাদিন বাড়ী থাকে না।সুকন্যা থাকে তিনতলায়।শাশুড়ীর সাথে বনিবনা নেই তাই শাশুড়ীর জায়গা দো-তলায়।রান্না করে কোনোরকমে। তারপরেই লেগে পড়ে সমাজ উদ্ধারে।ফোন নিয়ে বসে পড়ে।সুতরাং সারাদিন পি এন পিসি আর এর ওর পেছনে লাগার অখন্ড অবসর সুকন্যার।

এইবার বহুদিন বাদে আমি কলকাতা এসেছি।কর্মসূত্রে আমার পোস্টিং শিলং এ।বিয়ের পর থেকে পুরো পরিবার আমরা ওখানেই থাকি।সে প্রায় পঁচিশ বছর আগেকার কথা।এখন আমি সংসারী।বয়েস মধ্য আকাশে পৌঁছে গেছে।আমাদের বন্ধুদের সকলেরই এরকমই বয়স।এখন সকলকেই সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়।জীবনযাত্রার ধরনও অনেক পাল্টে গেছে। কলকাতায় আমার মা থাকে আমার বোনের কাছে।বোনের ভাড়া বাড়ী, তাই ও আমার বাপের বাড়ীতেই থাকে।একটা তলায় মা আর বোনেরা থাকে।আর একটা তলা লিজে ভাড়া দেওয়া।মা মাঝে-মাঝে এখানে আমার কাছেও আসে।আমি প্রায় বছর দশেক কলকাতা যেতে পারিনি নানা কারণে।তাই বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগটাও অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছিল।তপু মানে তপতী মাঝে- মাঝে ফোন করে।ও বলে রেখেছে-

”তুই শিলং থেকে এসেই কিন্তু আমার বাড়ী আসবি।কতদিন তোকে দেখিনি।”

আসলে পাহাড়ী জায়গায় নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা ।আর আমি অনেকটা উঁচুতে থাকি তাই আমার ফেসবুক নেই।হোয়াটস আপেও নেট ধরে না বললেই চলে।অফিসে গিয়ে কখনও- সখনও হয়তো হোয়াটস আপ দেখি।তাও আবার সময়ের অভাবে হয়ে ওঠে না।আসলে ফোনে মায়ের খবরটুকু নেওয়া ছাড়া আর প্রয়োজনীয় কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করার সময় নেই আমার।

এইবার আমি শিলং থেকে কলকাতায় এসেছি। কতদিন বাদে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন সকলের সাথে দেখা হবে তাই মনটা বেশ ভাল ছিল।এখানে এসে তপুর সাথে দেখা হলো অনেক-অনেক বছর বাদে।ও আমার সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধু।ওর বাড়ীতে কেটেছে আমার কত স্বর্ণালী দিন।একসাথে খাওয়া,সিনেমা দেখা,কেনাকাটা করা,গান শোনা আরও কত কি।একথা-সেকথা, কথা আর ফুরোতেই চায় না।আমি জিজ্ঞেস করলাম-

”কি রে আর সব বন্ধুদের কি খবর?চলনা একদিন সবাই দেখা করি!সুকন্যার কি খবর রে?ওর কার সাথে বিয়ে হল?তোর সাথে যোগাযোগ আছে?মনে আছে আমার আর তোর বন্ধুত্ব নিয়ে ও কিরকম হিংসা করত?”

”কি আর বলব!ও সেরকমই ছিল জানিস! নিজেকে বদলাতে পারেনি একটুও।”

তপু বলল।

”সেরকমই ছিল মানে?এখন কোথায়?”

এরপর তপুর মুখেই শুনলাম সুকন্যার ঘটনাটা।শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।সেই মতো ঘটনাটা বলছি।তপু বলতে শুরু করলো-

” তুই শিলং যাওয়ার পর আমি খুব একা হয়ে গেলাম।দিনের সিংহভাগ সময়টা তো তোর সাথে কাটতো আমার। স্কুলে পড়াকালীন তুই,আমি আর অতসী ছিলাম খুব ভাল বন্ধু।সুকন্যা এক একসময় এক একজনের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতো।কিন্তু আমরা ওকে বন্ধু বলেই ভালবাসতাম।আর জানতাম ওর একটু হিংসুটে স্বভাব।কেননা ছোট থেকেই ও কেবল মায়ের কাছে মানুষ।ওর বাবা ওর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনি।ফলে মামারবাড়ীতে কষ্ট করে ও বড় হয়েছে।তাই ও কিছু কমপ্লেক্সের শিকার।সেজন্যই হয়তো ও আমাদের তিনজনের বন্ধুত্ব সহ্য করতে পারতো না।বিশেষত আমার আর তোর বন্ধুত্বটা।”

”সে যাইহোক, তুই শিলং যাবার পর আমার সাথে অঞ্জনের একটা গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।তুই তখন সেসব জানতিস না।তোর চাকরি, নতুন সংসার,তিথির জন্ম,তোর বাবার মৃত্যু তোকে সব বন্ধুদের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দিল।অন্যদিকে পার্থ বলে একটা বখাটে ছেলে সুকন্যার পিছনে পড়ল।কিছুতেই তার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিল না ও।এদিকে ভয়ে সুকন্যার রাস্তা-ঘাটে বেরোনো বিপদজনক হয়ে উঠছিল।পার্থকে চটিয়ে কিছু করা যাবে না।যা করতে হবে খুব বুদ্ধি করে করতে হবে।এইমতো সব বন্ধুরা আমার বাড়ীতে বসে একটা মিটিং করলো। তাতে ঠিক হলো এমন কিছু প্রমাণ পার্থকে দেখাতে হবে যাতে ও ভাবে সুকন্যার অন্য কারো সাথে বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে।আর সে সম্পর্কটা প্রেমের সম্পর্ক।সেইমতো ব্যাক ডেটে দুটো চিঠি লেখা হল।প্রেমিক সাজলো অঞ্জন।সুকন্যাকে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়ে সে চিঠি লিখলো, আর সুকন্যা সে প্রস্তাবে রাজী হল।এই মর্মে দুটি চিঠি পার্থকে দেখানো হল।শুধু তাই নয় পার্থর কাছে ব্যাপারটা আরও জোরালো করে তুলে ধরার জন্য অঞ্জন-সুকন্যা দুচারদিন পার্থর সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করলো,উপহার আদান-প্রদান করলো।এইসব ঘটনার ফলে পার্থ বুঝলো সুকন্যা আর অঞ্জনের গভীর প্রেম। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো তাদের বিয়ে হবে।ভাগ্যের জোরে পার্থ সুকন্যার পিছু ধাওয়া করা বন্ধ করলো।

এদিকে প্রেমিক সাজতে গিয়ে অঞ্জন বুঝতে পারলো সুকন্যার ভেতর তপতীকে নিয়ে কিছু সমস্যা আছে।আর আছে একটা বিষাক্ত হিংসুটে মন।যাইহোক সমস্যা মিটে যাওয়ার পর যে যার চিঠি ফেরত দিয়ে দেবে এমনই কথা ছিল।সেইমতো চিঠি ফেরত দেওয়ার দিন এগিয়ে এলো। বিশেষ দিনটিতে সুকন্যা শুকনো মুখে উস্কো-খুস্কো চুলে,লাল চোখে অঞ্জনের সামনে এসে দাঁড়াল।অঞ্জন জিজ্ঞেস করলো-

”কি রে সুকন্যা তোর কি শরীর খারাপ?রাতে ঘুমোসনি?”

”না আমার দুদিন ঘুম হয়নি।কিছু খেতে পারছি না।শরীরটা খুব খারাপ।এই নে তোর চিঠি আর এইটা আর একটা চিঠি তুই এইটা পরে পড়িস।”

এই বলে আসি বলে সুকন্যা বাড়ী চলে গেল।

অঞ্জন চিঠি খুলে দেখে সুকন্যা লিখেছে-

প্রিয়তম অঞ্জন,

যদিও এই কদিন আমরা প্রেমের অভিনয় করেছি।এর ভেতর কোনো সত্যি নেই।কিন্তু আমার কাছে সবটাই সত্যি।অঞ্জন তোকে আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।তোর পাশে তপতীকে দেখলে আমার সারা শরীরের ভেতর কেমন একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা হয়। মনের ভেতর একটা মৃদু জ্বালা অনুভব করি।তুই আমাকে ভালবাসবি?তপতীর চেয়ে তোকে আমি অনেক বেশী সুখে রাখব।ও ভালবাসার কি বোঝে?তোকে না পেলে আমি বাঁচবো না।উত্তরটা আমার চাই।
ইতি
তোর সুকন্যা।”

”এই চিঠি হাতে পাওয়া মাত্রই অঞ্জনের মাথায় বজ্রপাত হলো।ও আমার কাছে ছুটে এল-

”তপু, তপু বিশাল কান্ড! দেখ, সুকন্যা আমাকে কিসব লিখে চিঠি দিয়েছে।দেখেছিস তো,এইজন্য আমি এইসব নাটকের ভেতর যেতে চাইনি।এইবার কি হবে বলতো?”

”আমি বললাম তুই ভালো করে ভেবে দেখ।হতেও তো পারে সত্যিই সুকন্যা তোকে ভাল রাখবে।আমার আর এমন কি আছে?

মনে-মনে আমার কেমন অভিমান হলো।ভালবাসার ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না।তবু ভাবলাম মেয়েটার বাবা নেই।আরও কিসব ভাবলাম! অল্প বয়েসের পাগলামি হয়তো।কেন যে এইসব ভাবলাম জানি না।আমি তো জানতাম যে অঞ্জনকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”

এদিকে অঞ্জন বলল-

”দেখ আমি যা করি,যা ভাবি সবেতেই তোর কথা মনে পড়ে।তোকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কথা ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি ওকে ডিরেক্ট না বলে দিচ্ছি।”

অঞ্জন সন্ধ্যেবেলা ওর ছোটবেলার বন্ধু দীপকে আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে সুকন্যাকে প্রত্যাখান করতে গেল।সেখানে অনেক কান্নাকাটি মান-অভিমান হলো।আমি প্রথমে যেতে চাইনি।কিন্তু অঞ্জন কোনো কথাই শুনলো না।সুকন্যা কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে গিলে খেতে লাগল।সুকন্যাকে এতো কান্নাকাটি করতে দেখে দীপের মন গলে গেল।দীপ চিরকালই একটু শ্রীকান্ত টাইপের।মেয়েদের দুঃখ সহ্য করতে পারে না।দীপ সুকন্যার প্রেমে পড়ল।দীর্ঘ টাল বাহানার পর সুকন্যা-দীপের প্রেমজ বিবাহটা হয়ে গেল।আমরা একসাথে হনিমুন পর্যন্ত গেলাম।”

এই পর্যন্ত বলে তপু থামলো।আমি বললাম ঠিক ই তো আছে।দুজনে দুজনকে বিয়ে করলি সুখে সংসার করছিস গল্প শেষ।এতে সমস্যার তো কিছু নেই।

তপু বলল-

” না এখানেই সমস্যার শুরু।এখানে সমস্যা শেষ হলে কি তোকে এত গল্প বলতাম?”



তপু আবার বলতে শুরু করলো-

”সুকন্যা দীপকে নিয়ে ভালোই সংসার করছিল।হনিমুন থেকে ঘুরে আসার কিছুদিন বাদে ওদের একটা ছেলে হল।নাম রাখলো সৌরভ।দীপের পারিবারিক বিসনেস ছিল।ওর ছেলে সৌরভ হবার পর কিসব ঝামেলায় সেই বিসনেস বন্ধ হয়ে গেল।অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে দীপ একটা চাকরিতে জয়েন করল।সেখানে প্রণতি বলে একজন মেয়ের সাথে ওর নতুন প্রেমের সম্পর্ক হলো। শোনা গেল ঐ প্রণতিই নাকি ওকে চাকরি করে দিয়েছে।অঞ্জন আর ওর বন্ধু-বান্ধবরা ওকে অনেক করে বোঝাল যে বিয়ের পর এইসব পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোটা ঠিক না।কিন্তু দীপ শুনলো না।”

বলল-

”সুকন্যা একটা পুতুল।ওর না আছে বুদ্ধি,না আছে অনুভূতি আর না আছে একজন পুরুষমানুষকে সুখী করার ক্ষমতা।ওকে নিয়ে কোনো রুচিশীল জায়গায় যাওয়া যায় না।পাশাপাশি থাকা যায় না।আনকালচারড মেয়ে একটা।”

অঞ্জন বলল-

”তুই তো ওকে ভালবেসে বিয়ে করেছিস।কতদিন মেলামেশা করেছিস তখন বুঝতে পারিসনি ও তোর যোগ্য নয়?বিয়ের পর যখন ছেলে হয়ে গেছে তখন এইসব বলছিস?এইভাবে কাউকে ঠকানো উচিত না।”

”কিন্তু কে কার কথা শোনে।প্রণতির সঙ্গে দীপের ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চলল।মন্দিরে গিয়ে দীপ প্রণতিকে বিয়ে করলো।প্রণতির ফ্ল্যাটেই ওরা দুজন থাকতে শুরু করলো।প্রণতি ডিভোর্সী আর ওর একটা মেয়ে আছে।এদিকে দীপ সুকন্যাকে ডিভোর্স দিতে চাইল কিন্তু সুকন্যা রাজী হলো না।শুধু তাই নয় দীপ বলতে শুরু করলো প্রণতির মেয়েকেও দীপ ওর সম্পত্তির ভাগ দেবে।অঞ্জন আর বাকি বন্ধু-বান্ধবরা অনেক করে বোঝাল।তাতে দীপ রেগে সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করলো।সুকন্যার বাপের বাড়ী বলতে মামারবাড়ী।সেখানে ওর মা নিজেই কোনোরকমে আছে।ওর মামারা ওকে আর থাকতে অ্যালাউ করবে না।তাই বাধ্য হয়ে এই পরিস্থিতি ওকে মেনে নিতে হলো।ওদের ভেতর একটা মৌখিক চুক্তি হলো।দীপ- সুকন্যা একই বাড়ীতে আলাদা থাকবে।দীপ ওর ছেলে আর সুকন্যার খরচ দেবে।পরিবর্তে সংসারের সব কাজ সুকন্যা করবে।অন্যদিকে সুকন্যার কোনো ব্যাপারে দীপ আর দীপের কোনো ব্যাপারে সুকন্যা মাথা ঘামাবে না।দীপ থাকবে বাড়ীর দোতলায় ওর মায়ের কাছে আর সুকন্যা আর ওর ছেলে থাকবে তিনতলায় সেখানে দীপের প্রবেশ নিষিদ্ধ হবে।”

আমি অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম।মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমা দেখছি।বললাম তারপর?তপু আবার বলতে শুরু করলো-

”এইভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কম্প্রোমাইজ করতে-করতে সুকন্যার ভেতর কিছু বিকার দেখা দিল।দীর্ঘদিন স্বামীর সান্নিধ্য, ভালবাসা না পেয়ে সংসারের যাঁতাকলে ও যেন মনের দিক থেকে বিষকন্যা হয়ে উঠল।কারো সুখ ওর সহ্য হতো না।সকলের সাথে নিজেকে অহেতুক তুলনা করতে শুরু করতো।এমন অবস্থায় মায়ের সান্নিধ্য হয়তো ওর কষ্টটা কমাতে পারতো।কিন্তু সারাজীবন কষ্ট করতে-করতে মাসিমাও একটা অদ্ভূত জীবে পরিণত হয়েছিলেন।সকলের সাথে ঝগড়া-ঝাঁটি,অন্যের দোষ ধরার ফলে,উনিও সকলের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।ফলে কেউই ওনার ব্যাপারে থাকতে চাইতো না।এমনকি একমাত্র নাতিটার প্রতিও ওনার কোনো টান ছিল না। আমাদেরকেও যদি মনের কষ্টটার কথা বলতো তাহলে আমরা হয়তো ওর জন্য কিছু করতে পারতাম।কিন্তু আমাদের কাছে পরিষ্কার করে সব কিছু বলা তো দূরের কথা, ও সকলের সাথে অদ্ভূত ব্যবহার করতে শুরু করলো।বানিয়ে- বানিয়ে ওর গল্প শুনতে-শুনতে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়।এছাড়া কাউকে অহঙ্কারী,কাউকে চালবাজ,কাউকে বড়লোকিয়ানার দায়ে অভিযুক্ত করে সকলের থেকে দূরে সরে যেতে লাগল।আমার মনে হয় ও কোনো হীনমন্যতায় ভুগছিল।তার ভেতর নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে হয়তো সকলের সাথে টেক্কা দিতে চাইছিল যার জন্য বিষয়টা আরও জটিল হয়ে উঠছিল। কেউ দীপের কথা শুনতে না চাইলেও জোর করে দীপ ভাল,দীপ ভাল গান জানে,দীপ অফিসের কত উঁচু পোস্টে আছে,দীপ ওকে কত স্বাধীনতা দিয়েছে সেসব কথা বলে বেড়াতে লাগল।এইজন্য সকলেই ওকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করলো।যে সময়ে সকলকে নিয়ে ওর চলার দরকার সেই সময়ে ও ভীষণভাবে একা হয়ে গেল।আমি বেশ বুঝতে পারলাম সবচেয়ে বেশী রাগ ওর আমার ওপর।দীপের সঙ্গে সম্পর্কটা এইরকম খারাপ হয়ে যাবার পর থেকে আমার সাথেও ও সব যোগাযোগ বন্ধ করলো।আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো।এই পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল।এরপর আর এক কান্ড ঘটল।”

আমি তপতীকে জিজ্ঞাসা করলাম আবার কি কান্ড করলো রে?ওর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল?

তপতী বলল-

একদিন সকালে বসে চা খাচ্ছি দেখি পরমা আমাকে ফোন করেছে-

”হ্যালো কে তপু?”

”হ্যাঁ রে বল।কি ব্যাপার এতো সকালে?সব ঠিক আছে তো?”

”হ্যাঁ রে ঠিক আছে।শোননা একটা ব্যাপারে ফোন করলাম।সুকন্যার সাথে তোর সম্পর্ক কেমন?”

আমি বললাম-

”আমার সাথে তো সুকন্যার ভালোই সম্পর্ক ছিল।ও তো আমার স্কুলের বন্ধু।তোর সাথেই খালি কলেজ থেকে বন্ধুত্ব।কিন্তু ইদানীং ও আমাকে খুব এড়িয়ে যাচ্ছে।কেন বলতো?কি হয়েছে?”

পরমা বলল-

”কদিন আগে আমাকে হঠাৎ সুকন্যা ফোন করেছিল।ওতো মাঝে-মাঝেই ফোন করে এইরকম আগডুম-বাগডুম বকে।কত সময় ফোন ধরিনা।আবার এক-একসময় ধরি।সেদিন অনেকবার করে ফোন করছিল বলে ফোনটা ধরলাম।দেখলাম ওর গলাটা কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো শোনাচ্ছে।আমাকে বলল-

”পরমা আজ যখন হোক একবার আমার বাড়ী আসতে পারবি? আমার খুব দরকার।”

আমি অনেকভাবে কাটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ও প্রায় কাঁদো-কাঁদো।তাই অফিস ফেরতা ওর বাড়ী গেলাম।শরিকী বাড়ী।এঘর -ওঘর থেকে উৎসাহী কয়েকটা মুখ উঁকি দিল।সেসব এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সুকন্যা সুকন্যা করে কয়েকবার ডাকাডাকির পর একজন বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলেন বেশ চিৎকার করে বললেন-

”ক্যাআআআআ?—ক্যাআআআআ?—কাকে চাই? বলা নেই কওয়া নেই একেবারে ওপরে উঠে এসেছে গা!কি হাড়হাভাতে মেয়েছেলে।ঐ আর এক আপদ জুটেছে কপালে সুকন্যা!সুকন্যা!কে যে ঐ অপয়া মেয়েছেলেটার এমন নাম রেখেছিল ভগমান জানে।সংসারটা আমার মরুভূমি করে দিলে গা!”

এইরকম আকস্মিক আক্রমণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।পাশের ঘর থেকে একজন অল্পবয়সী মেয়ে বলল-

”এইখান দিয়ে উঠে যান।তিনতলায় বৌদি থাকে।”

আমি তাড়াতাড়ি তিনতলায় উঠে দেখলাম সামনে একফালি বারান্দা।বারান্দা পেরিয়ে সুকন্যার ঘর।অগোছালো অপরিষ্কার,জামাকাপড় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে।খাট লন্ডভন্ড।খাটের একপাশে নাইটি পরে, এলোচুলে, বিকট লাল লিপস্টিক লাগিয়ে ,কড়িকাঠের দিকে ঊর্ধবমুখে তাকিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গী করে সেলফি তুলছে সুকন্যা।আমি চমকে গেলাম।আমাকে দেখে যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব করে আয় আয় করে ডেকে বসালো।বলল-

”নীচে আমার শাশুড়ী তোকে ধরেছিল নারে?খুব কুচুটে পাজি মহিলা।কিচ্ছু করতে চায়না।দিনরাত খালি শরীর খারাপ আর শরীর খারাপ।ইচ্ছে করে ঠাকুরঘরে গিয়ে বসে থাকে।পাছে কোনো কাজ করতে হয়।পাড়া বেড়ানোর সময় শরীর ঠিক হয়ে যায়।আমি রান্না করে ওদের দুজনের খাবার ফেলে রেখে চলে আসি।খেলে খাবে না খেলে না খাবে।আমি সাধতে যাইনা।ইত্যাদি আরও নানা কথা।”

আমি বললাম-

”এসব তো অনেকবার শোনা কথা সুকন্যা।আমি অফিসের দরকারী কাজ ফেলে এসেছি।তোর দরকারটা কি সেটা তো বল?”

হঠাৎ আমার হাত ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুকন্যা।বলল-

”আচ্ছা পরমা বলনা আমার ভেতর কি নেই?যা প্রণতির ভেতর আছে?তপুর ভেতর আছে?বলনা পরমা?বলনা!অঞ্জন তো আমাকে বিয়েটা করলেই পারতো।কেন তবে চিঠি লিখল?কেন তবে কদিন প্রেমের নাটক করলো?দীপ কেন আমাকে সরিয়ে দিল ওর জীবন থেকে?তপুর এতো অহঙ্কার কিসের? বাড়ী গাড়ী নিয়ে অঞ্জনকে নিয়ে সুখের দোকানদারি করছে কেন রে?”

”ওর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস তো তপু!বেশ বুঝতে পারলাম গভীর অবসাদে সুকন্যা মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে।তানাহলে এতো বছর আগের ঘটনা তুলে এখনও আফশোস করতো না।এখানেই শেষ না।কিছুক্ষণ বাদে ও একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেল।আমাকে খাটের একপাশে বসিয়ে গভীর নীচু গলায় অনেককিছু বলল।যেন খুব সিরিয়াস একটা ব্যাপার একটা বাচ্চা মেয়েকে বোঝাচ্ছে।আমি তো শুনে হাঁ হয়ে গেলাম।খুব খারাপ লাগল আমার।কেননা আমি জানি ওর একটু ফালতু বকা অভ্যেস।তাই আমি সেসব বিশ্বাস করলাম না।তোকে তাই ফোন করলাম।”

আমি বললাম-

”কি বলেছে সেটা তো বল।”

পরমা বলল-

”সুকন্যা বলেছে আজ ও চেয়েছে বলেই তুই অঞ্জনের বৌ হতে পেরেছিস।তুই নাকি অঞ্জনকে ওর থেকে কেড়ে নিয়েছিস।আসলে ঐ জায়গাটা তোর পাবার কথা নয়।ও দয়া করে তোকে ছেড়ে দিয়েছে।অঞ্জনের মন খুব ভাল।আসলে অঞ্জন ওকেই ভালবাসে।তোর সাথে সংসার করাটা একটা নাটক।এই কথাটা শুধু ও আর অঞ্জন জানে।তাই তোকে অঞ্জনের পাশে বৌ হিসেবে দেখলে ওর নাকি সারা শরীর জ্বলতে থাকে।ও তাই তোকে সহ্য করতে পারে না।আর সে কারণেই বন্ধুদের জমায়েতে বা যেখানে তুই যাস সেখানে ও যেতে চায় না।তবু সকলকে ও এই কথাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করছে।সকলে একদিন সত্যিটা ঠিক বুঝবে।এছাড়াও আরও নানা কথা বলছে যেগুলো খুব নিম্নরুচির কথাবার্তা।”

তপুর মুখে এইসব শুনে আমি তো থ।পরমা বলল শুধু যে ওকে বলেছে তাই নয়, এইসব কথা ও নাকি আরও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের কাছেও বলছে।

তপু বলল-

”আমি বুঝলাম আবার নতুন খেলা শুরু হয়েছে।সকাল-সকাল মেজাজটা খিঁচড়ে গেল।এইসব কথা যদি আমার শ্বশুরবাড়ীতে এসে পৌঁছোয় তাহলে কিরকম বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে সেটা ভাবতে-ভাবতেই সুতপা আর তার একটু পরেই অতসী ফোন করল।ওরাও প্রায় একই কথা বলল।আমি বুঝলাম চারিদিকে এইসব কথা বলে নতুন করে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করছে সুকন্যা।অঞ্জন তখন কাজে বেরোবে, তবু থাকতে না পেরে স্নান করে ঘরে আসতেই ওকে বললাম ঘটনাটা।”

”হঠাৎ আমার মনে হলো কদিন ধরে অঞ্জন খুব অন্যমনস্ক।রাতে ঠিক করে ঘুমোচ্ছে না খাচ্ছে না।কেমন একটা অস্থির ভাব।আমাকে বলল-

”তপু কদিন ধরে ভাবছি তোমাকে একটা কথা বলব।কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।আসলে কি যে বলব আর কি করব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।কিন্তু আর দেরী করা ঠিক হবে না।”

আমার বুকের ভেতরটা কেমন ধড়ফড় করতে লাগল বললাম-

”কি হয়েছে গো?শরীর খারাপ?ব্যবসার কিছু সমস্যা?”



অঞ্জন বলল-

” না সেরকম কিছু না।”

অঞ্জনের বড় জামাকাপড়ের শোরুম।চালু ব্যবসা।কাজের চাপও খুব।দোকানে অনেক কর্মচারী।অঞ্জন ছাড়া ওর ভাইয়েরাও পালা করে দোকানের ডিউটি করে।তবে এতো কাজের মাঝেও ও নিজেকে বদলে ফেলেনে।ও খুব মিশুকে আর হৃদয়বান মানুষ।অন্যের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়ে।আমি তপুর বরকে যতটুকু দেখেছি তাতে সকলের সাথে সবসময় হাসি মুখে কথা বলে, কোনো বিরক্তি নেই।অনেক বছর বাদে আমি শিলং থেকে এসেছি।দেখলাম অঞ্জন ঠিক আগের মতোই আছে।ও কিছুক্ষণ আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে দোকানে বেরিয়ে গেল।আমি আর তপু আবার গল্পে ডুবে গেলাম।আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম বললাম-

”তপু তারপর সুকন্যার কি হলো?”

তপু আবার বলতে শুরু করল।পরমার ফোনের কথাটা শুনে আমাদের কথার মাঝেই অঞ্জন বলল-

”জানো তপু দীপের চরিত্রটা কোনোদিনই ভালো ছিল না।বরাবরই ও বদলে বিশ্বাসী।একাধিক নারী- সঙ্গে অভ্যস্ত।দীপ যখন সুকন্যাকে বিয়ে করল তখন একটা এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে দীপ সম্বন্ধে আমার কোনোকিছু আর ওকে সেভাবে জানানো হয়নি।হয়তো আমি খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি চেয়েছিলাম সুকন্যার হাত থেকে।তাই দীপ সুকন্যাকে ঐ প্রেমের প্রস্তাবটা দিতেই তড়িঘড়ি ওদের প্রেমটা সাকশেসফুল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ইদানীং প্রণতির পরেও আর একটা হাঁটুর বয়সী মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।মাঝে-মাঝে মনে হয় ইচ্ছে করেই আমার দোকানের সামনে দিয়ে ঐ ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।কি জানি কি বোঝাতে চায়?হয়তো বলতে চায় যা ও পারছে তা আর কেউ পারে না।এটা খুব গর্বের বিষয়।যদি তখন সুকন্যাকে একটু সাবধান করতাম তাহলে হয়তো—-!

আসলে আমরা বন্ধুরা ভেবেছিলাম বিয়ের আগে কেউ- কেউ ওরকম একটু উড়নচন্ডী স্বভাবের থাকে।বিয়ে হলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু না!ঠিক হয়না। স্বভাব যায়না মলে।তবে এখন আমরা ওকে আর কিছু বলিনা।কেননা বলে কিছু লাভ নেই।সুকন্যাকে দীপ ঠিকমতো টাকাপয়সাও দেয় না।সুকন্যা ছেলেকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়াচ্ছে তাই খরচটাও অনেক।যে কথাটা বলব বলছিলাম সেটা হল, কিছুদিন ধরে আমার দোকানে হঠাৎ করে সুকন্যা আসা- যাওয়া শুরু করেছে।নানারকম দুঃখের কথা বলছে।আমি তো কয়েকবার টাকা-পয়সা দিয়ে হেল্পও করেছি।বলছিল কি একটা বিসনেস করবে।কি জানি।এদিকে টাকা-পয়সা নেই বিসনেস কি করে করবে জানি না!”

আমি বলেছিলাম-

”তোর যা সমস্যা তুই তপুকে বল।তপু আর অন্য বন্ধুরা ঠিক একটা কিছু ব্যবস্থা করবে।আমরাও আছি।কিন্তু সত্যিটা সকলকে বল।চিন্তা করিস না।এখানে আমাদের দোকানে অনেকরকম লোকজন থাকে।কাস্টমার থাকে।এখানে এত কথা বলা যায় না।সুকন্যা সেকথা তো শুনলোই না।উল্টে সেদিন বলল-

”তুই ভাবলি কি করে তপুর সাথে এইসব কথা আমি আলোচনা করব?তপু আজ তোকে পেয়েছে কার জন্য?আমার জন্য!ও তোর নখের যুগ্যি নয়।চিরকাল ও আমাকে সবেতে হারিয়েছে।স্কুলে নম্বরে হারিয়েছে।চুপ করে থেকে-থেকে মিষ্টি হাসি হেসে সকলের কাছে সেরা হয়েছে।সব কিছুতে বড় জেতার নেশা ওর।আর আমি আজ তোদের কাছে খারাপ হয়েছি না রে?তোর জন্য আমার এই অবস্থা।কেন মিথ্যে করে চিঠি দিয়েছিলি বল?কেন ছিনিমিনি খেলেছিলি আমার সাথে?আমি যদি চাইতাম তবে তোর কাছে তপু কি পৌঁছতে পারতো বল?বলনা, বলনা প্লিজ!”

”সুকন্যা একবার রেগে যাচ্ছিল আবার একবার কষ্টে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলছিল।কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।কি করতে চাইছিল ও।”

”অঞ্জন বলছিল আর আমি যেন ভয়ে-ভাবনায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম,এই ভেবে যে না জানি কি ঝড় ঘনিয়ে আসছে আমার সংসারে।”

”আমি অঞ্জনকে বললাম তারপর?তুমি তো আগে কিছু বলোনি আমায়?”

অঞ্জন বলল-

”আস্তে -আস্তে সুকন্যার গলা চড়তে লাগল।আমি খেয়াল করলাম দু একজন কাস্টমার আড়চোখে দেখছে।আর সেটাই স্বাভাবিক অনেকক্ষণ ধরে একজন মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো দোকানে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে কিসব বকে চলেছে।অথচ জামাকাপড় দেখছে না।ছোট ভাইটা কিছুটা পরে অবস্থা বুঝে-

” দাদা কিছু হয়েছে?”

বলে এগিয়ে এল।আমি ম্যানেজ করলাম।অনেক কষ্ট দোকানের বাইরে নিয়ে এলাম সুকন্যাকে।তারপর একথা-সেকথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ী পাঠালাম।কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম এইবার থেকে মাঝে-মাঝেই সুকন্যা আমার দোকানে হানা দেবে।বাড়ীতেও যে চলে যাবেনা তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।কেননা ওর চোখ-মুখ কথা-বার্তা কোনোটাই স্বাভাবিক লাগল না আমার।মনে হলো ওর মনের ভেতর চলছে প্রবল সাইকোলজিক্যাল ডিজওর্ডার।”

আমি তপুকে বললাম-

” একসাথে তোরা হনিমুন গেলি যখন, অথবা যখন তোরা একসাথে ঘোরা-ফেরা মেলামেশা করতিস তখন কি সুকন্যার ভেতর কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ত তোর?অথবা অঞ্জনের প্রতি বেশী কনসেনট্রেশন?”

তপু বলল-

”না তো।তখন তো দিব্যি ছিল। যেদিন থেকে দীপ ঐ প্রণতির সাথে থাকতে শুরু করলো,বিয়ে পর্যন্ত করে নিল; তারপরই ওর শুরু হলো বর প্রীতি।দীপ ভালবাসছে,দীপ শাড়ী কিনে দিচ্ছে,গয়না কিনে দিচ্ছে,ছবি তুলে দিচ্ছে আরও নানা বানানো গল্প বলতে শুরু করলো।প্রথম-প্রথম আমরা বুঝতে পারিনি।পরে সব জানাজানি হল।তখন বন্ধুদের প্রতি,আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ওর একটা তীব্র বিদ্বেষ কাজ করতে শুরু করলো।সকলেই বুঝতে পারলো সুকন্যা সাইকো পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছে।তারপরই ওর মনে হতে শুরু করলো অঞ্জনকে আমি ওর থেকে কেড়ে নিয়েছি।এইটা কিন্তু হঠাৎ একটা ভাবনা।যা আগে কখনও দেখিনি।পরে তো শুনলাম অঞ্জনের দোকানেও ধাওয়া করেছে।পরিচিতদের এইসব বানানো গল্প বলে বেড়াচ্ছে।”

আমি বললাম-

”এই ধরনের সাইকো পেশেন্টরা নিজেদের মনগড়া একটা জগৎ তৈরি করে বাস করতে থাকে।সে তার ইচ্ছেমতো মনের গভীরে কাল্পনিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।মনে-মনে যেটা চায়, মনে করে সেটাই সত্যি।বাকী সব মিথ্যে।অন্য সব ঘটনা তার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।অনেক সময় নিজের মনের ভেতর নানারকম অসম্ভব রকম ভাবনা ভাবতে-ভাবতে আসল কথা আর কিছুই মনে রাখতে পারে না।বানানো মিথ্যেগুলোই তার কাছে সত্যি হয়ে ওঠে।আর যাদের সম্পর্কে সেগুলো ভাবছে তারা যদি সেইমতো কাজ না করে তবে তাদের প্রতি রেগে গিয়ে যেকোনো ঘটনা ঘটাতে পারে এরা।আমার এইসব মানুষদের নিয়েই গবেষণা আর কাজ।তাই ওর কথা শুনে আমার এইটাই মনে হচ্ছে।যাইহোক তারপর কি হলো বল।”

তপু বলল-

”এর কয়েকদিন বাদে খুব সকালে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম।দেখলাম উস্কো-খুস্কো চুল, এলোমেলো শাড়ী,পাগলাটে চাহনি নিয়ে সুকন্যা দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দরজা খুলতে দেখেই সজোরে এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটতে-ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল ও।



”কোনোরকমে উঠে দরজাটা বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে আমিও দৌড়ে-দৌড়ে সুকন্যার পেছন-পেছন ওপরে উঠে গেলাম।ওপরে গিয়ে দেখি সুকন্যা সোজা আমার ঘরে ঢুকে গেছে।অঞ্জন একটু বেলায় ওঠে।আমি চা করে নিয়ে ওপরে এসে ওকে ডাকি ঘুম থেকে।কিন্তু সেদিন আমি ঘরে এসে দেখি সুকন্যা অঞ্জনের গা ঘেঁষে খাটের ওপর বসে পড়েছে-

”অঞ্জন, অঞ্জন আমাকে বাঁচা।আমাকে বাঁচা অঞ্জন।প্রণতি এই বাড়ীতে থাকতে শুরু করেছে।আজ আমি সকালে উঠে দীপ আর ওকে একসাথে বিছানায় ঘুমোতে দেখেছি।কি হবে আমার?আমি আর এখান থেকে যাব না।তুই আমাকে এখানে তোর বাড়ীতে থাকতে দিবি?বলনা?আমার তো এইটা আর একটা থাকার জায়গা বল?”

”আমি বললাম সেকি রে তপু?কি সাঙ্ঘাতিক কান্ড!”

তপু আবার বলতে লাগল-

”ততক্ষণে সুকন্যা অঞ্জনকে দুহাত দিয়ে জোরে আঁকড়ে ধরেছে।অঞ্জন হতভম্ব হয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।আমি বলছি সুকন্যা শান্ত হ।ছাড়! ছাড়! অঞ্জনকে ছাড়!কি করছিস?বাড়ীর কেউ এসে পড়বে।আমি তাড়াতাড়ি ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি।আমার মেয়ে ওর ঠাকুমার কাছে শোয় এইটাই যা রক্ষে!”

সুকন্যা তখন আস্তে-আস্তে আবার ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে।—পার্থ এসেছিল অঞ্জন—-পার্থ!— ও আমাকে ছাড়বে না—প্রণতি আমাকে বিষ দিয়েছে—ঐ খাবার আমি খাব না—আমার ছেলেটা প্রণতিকে ছোটমা বলে—কেন বলবে ছোটমা?—এই বিয়ে আমি মানিনা—-তপু তোকে আমি ছাড়ব না—তুই অঞ্জনকে কেড়ে নিতে পারবি না—কিছুতেই না—আমি অঞ্জনকে সত্যিকারের ভালবেসেছিলাম—-অভিনয় নয়—মিথ্যে নয়—–।”

”আমার মনে হল সুকন্যার বছরের হিসেব, বর্তমান অতীত,ভবিষ্যত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।ওর আর কিছু মনে নেই।এদিকে অঞ্জনকে ঐভাবে আঁকড়ে ধরতে দেখে আমার মনের ভেতর কেমন একটা ঝড় বইতে লাগল।যে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ভালবাসার ওম পেতে-পেতে রোজ রাতে আমি ঘুমোতে যাই আবার ঘুম থেকে জেগে উঠি।যার ভরসার হাতটা ধরে পেরিয়ে চলি এই কঠিন বাস্তব সংসার সমুদ্র।সেই অঞ্জনের বিস্তৃত বুকটাতে সুকন্যা মাথা দিয়েছে,অঞ্জনের হাতটা ধরেছে শক্ত করে উফফ্! মাগো আমার কি অবস্থা তোকে কি বলব!মনে হলো যেন আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।হাত পা কাঁপছে।এইরকম একটা পরিস্থিতি কি করে সামলাতে হয় আমার জানা ছিল না।”

”আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।সুকন্যাকে অঞ্জনের বুকের ওপর থেকে টেনে সরাতে গিয়ে দেখি সুকন্যা অজ্ঞান হয়ে গেছে।তাড়াতাড়ি জলের ঝাপটা দিয়েও কিছুতেই যখন ওর জ্ঞান ফিরলো না তখন অঞ্জন আমাদের হাউজ ফিজিশিয়ানকে ফোন করলো।ইতিমধ্যে দীপকে অঞ্জন ফোনে চেষ্টা করতে লাগল।কিন্তু কিছুতেই ফোনে পেল না।আমার মনে হচ্ছিল দমটা বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে।বাড়ীর লোকজন ততক্ষণে ঘরে এসে জড়ো হয়েছে।”

”কিছুক্ষণের ভেতর ড.পাল এসে গেলেন।উনি সুকন্যাকে কি একটা ইঞ্জেকশান দিলেন।প্রেশার চেক করলেন।পুরো ঘটনাটা শুনলেন।ইতিমধ্যে সুকন্যার জ্ঞান ফিরেছে।কিন্তু একটা ঘুমের ভাব রয়েছে।ড.পাল সুকন্যাকে ঘুমোতে দিতে বললেন।”

পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে তিনি বললেন-

”এইটা অ্যাকিয়ুট সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ।এই রোগে রোগী সামঞ্জস্যহীন কথাবার্তা বলে।মনগড়া অলীক জগতে বাস করে আর আশেপাশের সকলকে মনে করে শত্রু।নানাকারণে এই রোগ হয়।আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেকেই এই রোগের শিকার।কারোর- কারোর টা বোঝা যায় কারোরটা বা বোঝা যায় না।খুব কঠিন জীবন সংগ্রাম যখন মনের ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করে তখন সবসময় মানুষ সে চাপটা লোকলজ্জায়,মিথ্যে স্ট্যাটাস রক্ষা করতে গিয়ে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে না।আর তখনই মানসিক অবসাদে ডুবে যায়।তবে ঠিকমতো চিকিৎসা, সহানুভূতি আর গভীর ভালবাসায় এই রোগ সেরে যায়।আপনারা দ্রুত ওনার মানসিক চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করুন।কেউ যেন ওনাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে পাগল না বলে এইটা খেয়াল রাখবেন।আর এই ওষুধগুলো চলুক। কতকগুলো টেস্ট লিখে দিলাম।আপাতত ঘুমের ইঞ্জেকশান দেওয়া আছে।এখন ওনাকে ডাকবেন না।”

”এই বলে ড.পাল চলে গেলেন।ততক্ষণে অঞ্জন দীপকে ফোনে ধরতে পেরেছে-

”হ্যালো কে দীপ?কোথায় তুই ?কখন থেকে তোকে ফোনে পাচ্ছি না।এদিকে ভীষণ বিপদ।তুই এক্ষুণি আমার বাড়ীতে চলে আয়।”

”আর বিপদ! এদিকে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে অঞ্জন।কি করব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমার অফিসের তিনলক্ষ টাকা রাখা ছিল বাড়ীর লকারে।আজ সকালে একজনকে পেমেন্ট করার কথা ছিল।কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।গতকাল প্রণতি রাতে এখানে ছিল।আজ সকাল থেকে ওকে দেখতে পাচ্ছি না।ওর মেয়ের ফোন, ওর ফোন কারোর ফোনই পাচ্ছি না।এদিকে আমার মায়ের গলার সোনার হার,হাতের চুড়ি কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না।আমি কি করব,কোথায় যাব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।আজ টাকা পেমেন্ট না করতে পারলে আমার চাকরিটাও হয়তো থাকবে না।চুরির দায় এসে পড়বে আমার ওপর ।”

”তুই এখানে আয় আগে।দেখছি আমরা সবাই আছি কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।সুকন্যার শরীর খুব খারাপ।ও আমার বাড়ীতে রয়েছে।ডাক্তার দেখেছে।”

”সেকি! কি হয়েছে?আচ্ছা আমি আসছি এক্ষুণি।”

আমার মুখে তখন কথা সরছে না।বললাম তারপর?তপু বলল-

”তারপর দীপ এল। অঞ্জনরা তিন বন্ধু মিলে দীপের তিনলক্ষ টাকা জোগাড় করে দিল।সে যাত্রায় দীপের চাকরিটা বেঁচে গেল।”

”এরপর সুকন্যার ট্রিটমেন্ট শুরু হল।আমরা এত কিছুর পরও ওদের পাশ থেকে সরে যেতে পারলাম না।ছোট্টবেলার স্কুলের সেই সুকন্যার কথা মনে পড়ল।যে সুকন্যা বাবার কথা শুনে আড়ালে চোখ মুছতো।মায়ের ভালবাসার কথা শুনলে যার চোখ ছলছল করে উঠতো।যে কোনোদিন একটু ভাল টিফিন খায়নি,একটা ভাল জামা পরেনি।বন্ধু হয়ে পারলাম না ওকে দূরে সরিয়ে দিতে।কেননা আমরা বুঝলাম ও যা করেছে তা অসুস্থ মানসিকতায় করে ফেলেছে।তাই ওকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে সকলে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিলাম। বন্ধুদের সকলের আর দীপের চেষ্টায় সুকন্যা আস্তে-আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল।”

আমি বললাম-

”প্রণতির কি হলো?”

তপু বলল-

”প্রণতির আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।থানায় ডায়েরী করা হয়েছিল।কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।খোঁজ মেলেনি।”

আমি বললাম-

”এখন দীপ- সুকন্যা কেমন আছে?”

তপু বলল-

”সুকন্যা হাতের কাজ শিখেছে।নানারকম হাতের কাজের জিনিস বিক্রি করে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করে।ছেলের পড়াশোনা প্রায় শেষ।দীপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।সুকন্যাকে নিয়ে ভাল আছে।বন্ধু হয়ে যে বন্ধুকে বাঁচাতে পেরেছি।এইটাই আমার মনের বিরাট শান্তি রে।”

আমি তখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ করেছে।ঝোড়ো হাওয়া বইছে অল্প-অল্প।কিছুক্ষণের ভেতর ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামলো।গাছপালাগুলো সব বৃষ্টির জলে ভিজে সবুজ হয়ে উঠল।ভাবলাম হয়তো এখন এই অঝোর বাদলে দীপ- সুকন্যা পুরোনো মান-অভিমানের খেলায় মেতে উঠেছে,হয়তো এই বৃষ্টির জলে ওদের মনের সব মালিন্য মুছে যাচ্ছে।আমরা দুই বন্ধু তখন আনমনে জানলা দিয়ে ভিজে কাঠচাঁপা ফুলের গন্ধ প্রাণ ভরে নিতে-নিতে গানের সুরে গলা মিলিয়েছি-

”বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে,
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।”

(শেষ)
নবীনতর পূর্বতন