: বৌদি দরজা খোলো।
: বৌদি দোহাই লাগে তোমার দরজাটা
খোলো।
আজ সিঁদুর দেয়ার দিন, আর নবনিতা আজ তার সিঁদুর ঘঁষে ঘঁষে তুলছে। যে সিঁদুর পড়ায় ভালোবাসা নেই, নেই কোনো আনন্দ, আছে কেবলই অপমানের জ্বালা। হাতের চুড়ি,শাখা, পলা সব খুলে নিল। গলা, কানে হাতে যত গয়না ছিল সব খুলে ফেলে দিল বাথরুমের ফ্লোরে। এ যেনো সধবার চিহ্ন নয়, একে একে খুলে ফেলছে তার কুড়ি বছরের লজ্জা অপমান আর অবহেলার চিহ্নকে। বিথিকার গলা আবারও পাওয়া গেলো সাথে ছোট ননদের গলা।
: বৌদি দোহাই লাগে দরজাটা খোলো।
দরজা খুলল নবনিতা, চোখদুটো তার জবাফুলের মতো টকটকে লাল। লাল পেড়ে সাদা শাড়ীটার এখানে ওখানে লেগে আছে সিঁদুরের রঙ। ভেজা শাড়ী ভেজা চুল বেয়ে পানি পড়ছে ফ্লোরে। নবনিতার এই মূর্তি দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো তার ননদ। দরজায় ভীড় জমিয়েছেন নানা বয়সের নারী আত্মীয়েরা। বিথিকা চোখের ইশারায় তার ননদকে বললো দরজা থেকে এদের সরাতে। কেউ সরতে চাইছে না। নতুন বিধবা সবার কাছে এক দর্শনীয় বস্তু। সে কিভাবে কাঁদছে, কিভাবে স্বামী শোক প্রকাশ করছে, এটা যে বিশাল এক গল্পের খোরাক। খানিকটা জোর খাটিয়ে এই সমাবেশকে দরজা থেকে সরাতে হলো বিথিকাকে। এতে অনেকেই অসন্তুষ্ট হলো। নবনিতার গা মাথা মুছিয়ে দিয়ে কাপড় বদলাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেলো বিথিকা। কোন শাড়ী পড়াবে? খানিকটা দ্বিধা নিয়ে একটা তাঁতের শাড়ী বের করলো। সাথে ব্লাউজ পেটিকোট।
: বৌদি এটা পরে নাও। না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে। বললো বিথিকা।
কোনো উত্তর দিলো না নবনিতা, যেমন ছিল তেমনই বসে রইলো।
: বৌদি, কাপড়টা পাল্টাও, তোমাকে যেতে হবে, দাদাকে শনাক্ত করতে।
: আমি যাবো না। খুব হালকা অথচ খুব দৃঢ় স্বরে বললো নবনিতা।
নবনিতার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যে চমকে গেলো বিথিকা।
কথা না বাড়িয়ে নবনিতাকে কাপড় পাল্টানোর সুযোগ দিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো ।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল দেবাশিষের সাথে। এমনই এক পূজোর সময়। নবমীর দিনের এক অনুষ্ঠানে দেবাশিষ ও তার মা দেখেছিলেন নবনিতাকে। সেদিন স্টেজে উঠে একটা রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিল নবনিতা। তাতেই মা ছেলে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আহামরি সুন্দরী বলতে যা বোঝায় নবনিতা তা নয়। তবে আলগা একটা চটক আছে চেহারায়। সেই ষোলো বছর বয়সেই ভরা যৌবন তার শরীরে। সেটাই কাল হলো তার জীবনে। পূজো শেষ হওয়ার মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো। স্কুল ফাইনাল দিয়ে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ কি তা তার জানাই হলো না, স্কুলে বরাবর প্রথম হওয়া মেয়েটির। মা বাবা তার স্বামী ভাগ্য দেখে খুশী আর আত্মীয় স্বজনরা খানিকটা ঈর্ষান্বিত। সে নিজেও নিজের স্বামীভাগ্য নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল সে সময়। আর করবে না ই বা কেন? দেবাশিষ শুধু পড়ালেখায়ই নয় দেখতে যেমন সুপুরুষ তেমনি বিত্তবান। এক টাকাও পণ নেয়নি। কোনো জিনিস পত্রও নয়। সে বারবার বলেছিল তার শুধু নবনিতাকেই চাই। এমন পাত্রতো লাখে একটাও মিলে না। তবে তাদের একটাই শর্ত ছিল, বাবার বাড়ী একা আসা হবে না, দেবাশিষ নিয়ে আসবে। মেয়ের সুখের কথা ভেবে তারা সেটা মেনে নিয়েছিলেন। তারা ভেবেছিলেন এটা তো আরও আনন্দের বিষয় তাদের জামাই মেয়েকে নিয়ে আসবে। তারা কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন পাঁচ বছরেও জামাইয়ের সময় হবে না মেয়েকে নিয়ে আসার। পূজোপার্বন তো বাদ এমন কি জামাই ষষ্ঠিতেও তার সময় হলোনা। প্রথম বছরটা নবনিতার চলে গিয়েছিল স্বপ্নের মতো। দেবাশিষ তাকে ইংরেজী কথা বলার ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিল। কেতাদুরস্ত আধুনিক পোষাক পড়া শেখালো। অজ পাড়াগাঁয়ের গন্ধ গা থেকে মুছে ফেলার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই করলো। এক বছর পর পূজোর সময় মা বাবার সাথে যখন দেখা হলো তাদেরই নিজের মেয়েকে চিনতে কষ্ট হলো।
: আমার বর তোমাকে এমন লো-কাট গলার ড্রেসটা বানাতে বলেছে?
: অবশ্যই। সে নিজেই তো আমাকে বলেছে আরেকটু ফিটিং আর গলাটা যেনো বড় হয়। আর লংড্রেসটা পড়ে হাঁটলে হাঁটু পর্যন্ত যেনো বের হয়। মূল পোশাকটায় নিচে অল্প একটু কাটা ছিল। তবে তোমার হাজবেন্ডের পছন্দ আছে বলতে হয়। তোমাকে দারুন লাগছে। যে কোন মুম্বাইয়ের নায়িকাকেও আজ তুমি হার মানাবে বলে ইঙ্গিত পূর্ন চোখ টিপলো ডিজাইনার।
কি করা উচিত বুঝতে পারছে না নবনিতা। এই কাপড় পরে সে কিভাবে বাইরে যাবে। মানুষজন তো হা করে তাকিয়ে থাকবে। তার ভাবনাচিন্তার মধ্যেই ত্রানকর্তা হিসেবে হাজির হলো দেবাশিষ। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল নবনিতার দিকে। বললো, আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও শতগুন সুন্দর লাগছে তোমাকে সুইটি। তুমি আজ আমার কল্পনাকেও হারিয়ে দিয়েছো। বলে পকেট থেকে একটা বক্স বের করলো দেবাশিষ। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ ডিয়ার। নাও এটা তোমার বার্থ ডে গিফট। একটা চেইন লকেট পড়িয়ে দিল নবনিতার গলায়। লকেটটা এসে বুকের খাঁজের একটু উপরে এসে থেমে গেলো। ওয়ান্ডারফুল, বললো ডিজাইনার মহিলাটি। এটারই শুধু কমতি ছিল। আপনার টেস্ট আছে স্যার। নিজের প্রশংসা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো দেবাশিষ। মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার পেমেন্ট জমা হয়ে গেছে ব্যাংকে। আশা করি হতাশ হতে হবে না আপনাকে। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো মহিলা অর্থাৎ এবার তুমি বিদায় হও। থ্যাংক ইউ স্যার, আশা রাখি ম্যাডামের নেক্সট ড্রেসের ডিজাইনটাও আমরা করবো, বলে বিদায় নিল মহিলা। মহিলাটি বের হয়ে যেতেই নবনিতার কোমর জড়িয়ে ধরলো দেবাশিষ। কপালে ছোট করে একটা চুমু খেলো।বললো, টেনশন করোনা। আমি তোমার অস্বস্থিটা বুঝতে পারছি। হাই সোসাইটির লোকেরা এসব নিয়ে কথা বলে না, দেখো উল্টো তোমার প্রশংসা করবে।তবুও দ্বিধা যায়না নবনিতার, খানিকটা সংকোচ নিয়ে পার্লার থেকে বের হয় সে। পুরুষ মানুষের চোখের ভাষা যে কত প্রকার হতে পারে সেদিনের অনুষ্ঠানে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল নবনিতা। প্রতিটা চোখ যেনো তাকে গিলে খাচ্ছিল। তার অস্বস্থিটা বুঝতে পেরে হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছিল দেবাশিষ।বলেছিল আস্তে আস্তে খাও ভালো লাগবে। না, সে আস্তে আস্তে খায়নি। টেনশনে গলা বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। একচুমুকে সবটুকু পানিয় শেষ করছিল। এক গ্লাস নয় পাশপাশি দু গ্লাস। না, দেবাশিষ ভুল বলেনি। পানিয়টুকু খাওয়ার পর থেকেই তার সংকোচ দূর হয়ে গেলো। বরং পার্টিটা তার ভালো লাগতে লাগলো। সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে এটাও ভালো লাগতে লাগলো। সেই রাতের পার্টিতে নবনিতা শুধু দেবাশিষের সাথেই নয় বিদেশি অতিথীদের সাথেও ড্যান্স করলো মিউজিকের তালে তালে।
আর মোবাইলে কথা বলার মতো তার কেউ নেইও। যাদের সাথে প্রয়োজন ল্যান্ডফোনেই হয়ে যায়।দেবাশিষ খুব গোছানো স্বভাবের। এই বাসায় অনেকদিন থেকেই সে একা থাকে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট। ড্রইং ডাইনিং আর একটা স্টাডিরুম। ফ্ল্যাটটা যদিও কেনা তবুও দেবাশিষ তার কাজের সুবিধার জন্য এটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে। ফ্ল্যাটটার দুটো বেডরুমের মধ্যের দেয়ালটা ভেঙে একটা বড় বেডরুম করেছে। মূল দরজা খুলে দিলে কাজের লোকেরা এসে তাদের কাজ করে দিয়ে যায়। বেড রুমে ওদের ঢোকা পছন্দ করে না দেবাশিষ। বেডরুমটা সে নিজেই ক্লিন করে এখন অবশ্য নবনিতাও করে। দুটো কাজের লোক। দুজনই খুব ভোরে আসে। একজন ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, লন্ড্রি আয়রন সবই তার কাজ। অন্যজন রান্নার লোক। সে সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের রান্না সবই করে দিয়ে যায়। ন’টার ভেতর এরা সব কাজ করে দিয়ে চলে যায়।খুব প্রয়োজন পড়লে রাতে ফোন দিলে রান্নার লোকটি আসে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে বাইরের মানুষের উপস্হিতি দেবাশিষ পছন্দ করে না। এজন্য তার কোনো ড্রাইভার নেই। গাড়ীটা সে নিজেই চালায়।
প্রথম প্রথম খুব অবাক লাগতো নবনিতার পুরুষ মানুষ এসে ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়, এ কেমন কথা। সে সারা জীবন দেখেছে মা কাকীরাই তো ঘরের কাজ করে। বেশি হলে কাজের মাসি এসে একটু সাহায্য করে দিয়ে যায়। এখানের সবই উল্টো। কাপড় ধুয়ে দেয় মেশিন, এমনকি বাসন হাড়ি ধোয়ার জন্যও মেশিন ব্যবহার করে কাজের লোকটা। ওটার নাম নাকি ডিশ ক্লিনার। এ সবই একটা একটা করে তাকে চিনিয়েছে দেবাশিষ। কাজের লোকদুটো বের হবার পরপরই নবনিতাকে নিয়ে দেবাশিষ বেড়িয়ে পড়ে। নটায় নামিয়ে দেয় ইয়োগা ক্লাসে। পাশেই ইংলিশ লার্নিং সেন্টার সেখানে প্রায় দুটো পর্যন্ত একটানা ক্লাস থাকে। দুপুরে এক সাথে লাঞ্চ করে একটু গড়িয়ে নিয়ে আবার দু জনই বের হয়ে যায় দেবাশিষ তার ব্যবসার কাজে। আর নবনিতার কোনো দিন কুকিং ক্লাস কখনও গানের কখনওবা মেকাপের ক্লাস। এভাবেই চলছে গত দেড় দু বছর। ছুটির দিনগুলো অবশ্য অন্যরকম যায়।
আজ ছুটির দিন। বাইরে যাবার তাড়া তেমন নেই। তাই সকালবেলাটা একটু গড়গড়ি করে কাটছে দুজনের । গতকালকের পার্টির ক্লান্তিও আছে।
: তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। নবনিতাকে আদর করতে করতে বললো দেবাশিষ।
: কি? আধো ঘুম আধো জাগরনে জবাব দিল নবনিতা।
: আজ তুমি থাইল্যন্ড যাচ্ছো।
: মানে? কখন? ঘুমটা ছুটে গেলো নবনিতার।
: জ্বী, আজই। নাস্তা করেই আমরা এয়ারপোর্ট রওয়ানা দেবো।
: আমার জামা কাপড় গোছাতে হবে না। আমি কখন এসব করবো।
: মহারাণী আপনাকে এসব কিছুই করতে হবে না, আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি। মাত্র তো দুটো দিন। আজ যাওয়া কাল থেকে পরশু ফেরা। আজ কি পড়ে যাবেন তাও রেডি। আপনি শুধু শাওয়ার নিয়ে কাপড় পাল্টে আসবেন। শাওয়ার করতে গিয়ে গুনগুন করে করে গান গাইতে লাগলো নবনিতা। তার জীবনে আজ প্রথম বিদেশ ভ্রমন। কার এমন ভাগ্য। স্বামী গর্বে গরবিনী নবনিতার দুঃখ একটাই, নিজের এই সুখটুকু কাউকে দেখাতে পারছেনা এমনকি গল্পও করতে পারছেনা। যাবো যাচ্ছি বলে দুটো বছর চলে গেলো তবু বাড়ী যাওয়া হলো না।
ব্লু স্কার্ট এর মধ্যে পিঙ্কফুল আর তার সাথে মেলানো পিঙ্ক কালারের শর্ট স্লিভের টপ। চমৎকার মানিয়েছে নবনিতাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা মেকাপ নিল নবনিতা। আইলাইনার দিয়ে চোখটা আঁকার পর নিজেই মুগ্ধ হলো। সাজগোজ সে ভালই শিখেছে। গলায় চিকন চেইন সাথে পিঙ্ক পার্লের লকেট আর হাতে পার্লের একটা ব্রেসলেট। তার সাজগোজ কমপ্লিট। একটু খুঁত খুঁতানি রয়ে গেলো চিকেন কাপড়ের টপটা একটু পাতলা। এয়ারপোর্ট যখন পৌঁছলো তখন ফ্লাইট ছাড়তে ঘন্টা খানেক বাকী। সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে দেবাশিষ তাকে নিয়ে প্লেনে উঠলো। জীবনে প্রথম প্লেনে ভ্রমন খানিকটা ভয়ভয় করছিল নবনিতার। অভয় দিল দেবাশিষ। ভয় নেই আমি আছি।
ওরা যখন থাইল্যান্ডের হোটেলে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। রাস্তায় আসার পথে একটা রেষ্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে । চারিদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। খুবই সুন্দর লাগছে চারিদিক। হোটেলের রুমের চাবিটা নবনিতার হাতে দিয়ে বললো, তুমি রুমে যাও, পোর্টার তোমার লাগেজ নিয়ে তোমার সাথে যাবে। ভয় নেই আমার ছোট্ট একটা কাজ আছে ওটা শেষ করেই আসছি।
গতকাল তার আঠারো পূর্ণ হলো। আজ তাদের বিশেষ দিন। সত্যিকার অর্থে আজই তার ফুলসজ্জা। কথাটা মনে করে খানিকটা লজ্জা পেলো নবনিতা। অপেক্ষার প্রহর যেনো কাটছে না। এতো দেরি করছে কেনো দেবাশিষ। ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠলো।ধরবে কি ধরবে না খানিকটা দ্বিধায় ভুগে ধরে ফেললো ফোনটা। হ্যালো বলতেই ও পাশে দেবাশিষের গলা শুনে জানে পানি পেলো।নবনিতা আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমার এক ক্লায়েন্ট আজ তোমার সাথে থাকবে। তুমি তার সাথে কোনোরকম উল্টা পাল্টা ব্যবহার করবে না। আমি কি বলছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। তার সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করছে তোমার দেশে ফেরা না ফেরা। সে অসন্তুষ্ট হলে তোমাকে এভাবে প্রতিরাতে কারও না কারও সাথে রাত কাটাতে হবে। আর সে খুশী হলে আমি যেমন ভুলে যাব আজ কি হয়েছিল, তুমিও ভুলে যাবে আজকের রাতের কথা। আমরা আগে যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো।। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি।
: এসব তুমি কি বলছো দেবাশিষ? কান্নায় গলাটা বুজে এলো নবনিতার।
: এখন কান্নাকাটি বন্ধ কর। মিষ্টার আগরওয়াল এখনই রুমে আসবে। ও, আরেকটা কথা রুমটা কিন্তু মি: এন্ড মিসেস আগরওয়ালের নামে বুক করা।আর তোমার পাসপোর্ট টিকেট টা কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা মাথায় রেখো। বলে ফোনটা কেটে দিল দেবাশিষ। দেবাশিষের প্রতিটা কথা তীরের মতো বিঁধতে লাগলো, এসব কি বলছে দেবাশিষ। কিছুই ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছে না নবনিতা। তাহলে এতো দিনের সব কিছুই দেবাশিষ করেছে নিজের প্রয়োজনে। আসলেই তাই। নবনিতার নিজেকে একটা ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো মনে হচ্ছে। দেবাশিষ তাকে দুনিয়ায় চলার উপযোগী করে তৈরি করেনি, বানিয়েছে তার ইচ্ছের পুতুল। তার এই মুহূর্তে দেবাশিষের ইচ্ছের বলিদান হতে হবে। ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে।।অনেক পানি প্রয়োজন, সামনে রাখা বোতলটা খুলে গলায় ঢাললো নবনিতা। জ্বলে পুড়ে নামলো পানিয়টা। কি খেলো বুঝতে পারলো না। শুধু বুঝতে পারলো ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। আবারও বোতলটা উপুর করলো গলায় অর্ধেকটা খালি করে তবে থামলো। কিছুটা সময় ঝিম ধরে বসে রইল। তারপর সবকিছুই কেমন যেনো ভালো লাগতে লাগলো। একবার মনে হলো সে পাখি হয়ে গেছে। উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে মায়ের কাছে আবার তখনই মনে হল সে কিভাবে যাবে, তার পাসপোর্ট টিকেট সবইতো দেবাশিষের কাছে। এভাবে এলোমেলো ভাবনায় কতক্ষন চলে গেছে বুঝতে পারলো না। তবে মাথায় একটা জিনিস ভালো করেই ঘুরতে লাগলো, যে করেই হোক তাকে দেশে ফিরতে হবে।
মিষ্টার আগরওয়াল এলেন। খানিক্ষন হিন্দি উর্দু ইংরেজী মিলিয়ে গল্প করার চেষ্টা করলেন। সব কথার মধ্যে একটা কথাই বুঝতে পারলো, তিনি ভার্জিন মেয়ে পছন্দ করেন। ভার্জিন না হলে তিনি কোনো অচেনা মেয়ের সাথে রাত কাটান না ইত্যাদি ইত্যাদি।আগরওয়াল সাহেব বোতলের পানীয়টি
দুটো গ্লাসে ঢাললেন, একটা বাড়িয়ে দিলেন নবনিতার দিকে। নবনিতা এক ঢোকে পুরোটা ঢেলে দিল গলায়। জ্বলেপুড়ে নামলো পানিয়টি।
মাথাটা ভার নিয়ে সকালে ঘুম ভাংলো নবনিতার। বুঝতে পারলো আগরওয়াল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।
: ইয়েস আই এম হান্ড্রেট পার্সেন্ট সেটিসফাইড এন্ড হ্যাপি। ইওর ডিল ইজ ডান। মে সিগনেচার কারদুংগি। নবনিতাকে চোখ খুলতে দেখে বল্ল, আমি রুম সার্ভিসকে ব্রেকফাস্ট অর্ডার করেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। ওয়াশ রুমে এসে সেদিনও এভাবে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছিল নবনিতা। ঘঁষে ঘঁষে পাপ দূর করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বুঝে গিয়েছিল যে পঙ্কিলতার গর্তে সে পড়েছে তা থেকে তার মুক্তি নেই।।
গত আঠারোটা বছর এই পাপ তার পিছু ছাড়েনি। দেবাশিষ তাকে পুতুলের মতো ব্যবহার করছে তার প্রয়োজনে যথেচ্ছ।
তার সমস্ত অপমানের আজ মুক্তি মিলেছে। এই শ্বেতশুভ্র বসন আজ তার মুক্তির প্রতিক। ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো নবনিতা ঢুকলো গিয়ে শ্বাশুড়ী মায়ের রুমে, মা, আমি যাচ্ছি, আজ আমার মুক্তি মিলেছে। ঠিক তখনই ঢাকের বাদ্য তীব্রস্বরে বেজে উঠলো। এমন সময় দেবাশিষের ছোট বোন নিলিমা দৌঁড়ে মায়ের রুমে এলো, মা, দাদা বেঁচে আছে। দাদার গাড়ী দুর্ঘটনায় পড়েছে ঠিকই কিন্তু গাড়ীতে দাদা ছিল না। ছিল দাদার ম্যানেজার। সে ই মারা গেছে। দাদা কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ী আসছে।বলেই আবার একছুটে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলো।
নবনিতার শ্বাশুড়ী সুলেখা সবই জানতেন। সে সবই জানিয়েছিল শ্বাশুড়ীকে। কিন্তু তিনিও নিরুপায় জানিয়েছিলেন নবনিতাকে। বিদায় বেলায় নবনিতার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, অসুর বধ হয়নি, তাতে কি? সে বাড়ী ফিরবার আগেই তুই যা। আমি জানি আজ তুই মন থেকে তোর স্বামীকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিস। তুই মুক্ত। এখানে কিছু গয়না আছে, এটা নিয়ে যা, কোনো ভালো কাজে খরচ করিস। এটা আমার মায়ের দেওয়া গয়না। এতে কারো অধিকার নেই। বাড়ীর বাইরে পা রাখলো নবনিতা। নির্মল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিল। মুক্তির শ্বাস।।
পনেরো বছর পর:
নবনিতা দাড়িয়ে আছে ‘নব’ অনাথালয় ও নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের বারান্দায়। এমন সময় দশ বারো বছরের একটি ছেলে এসে খবর দিল মা, একজন লোক এসেছে, বলছে এখানকার পরিচালক কে? তার সাথে দেখা করতে চায়।
অফিস ঘরে নিয়ে আয়। বললো নবনিতা।
হুইল চেয়ারে করে যে লোকটি ঢুকলো তাকে এখানে আশা করেনি নবনিতা।লোকটির দুটো পা ই হাঁটুর উপর থেকে কাটা। লোকটাও খানিক চমকালো নবনিতাকে দেখে। দুটো চেক বাড়িয়ে দিল নবনিতার দিকে। বললো, প্রথমটা আমার মায়ের দেয়া দশ লক্ষ টাকার। ২য়টা আমার পক্ষ থেকে পচিশ লক্ষ টাকার।প্রথম চেকটা নিল নবনিতা, দ্বিতীয়টা ফিরিয়ে দিল। বললো, কারো পাপের টাকা আমাদের আশ্রমে আমরা নেই না।